Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 4:21 pm

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ডলার চলে যাচ্ছে চীন থেকে আমদানিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া দেশটি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সও আসে বাংলাদেশে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানি খুবই কম। চীনের ক্ষেত্রে আবার তার উল্টো চিত্র। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আমদানি উৎসের নাম চীন। তবে দেশটিতে রপ্তানি খুবই নগণ্য। এছাড়া চীন থেকে তেমন কোনো রেমিট্যান্সও আসে না। ফলে চীনের সঙ্গে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাড়ছে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স থেকে যে পরিমাণ ডলার আসে তার বেশি চলে যায় চীন থেকে আমদানি ব্যয় মেটাতেই। যদিও দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে নানা ধরনের বাঁক দেখা গেছে। এতে আগামীতে বাংলাদেশ দুই বৃহৎ শক্তির দেশের মধ্যে কোনটিকে বেছে নেবে তা স্পষ্ট নয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গত পৌনে ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে বিদায়ী অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৮২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। একই সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স এসেছে ৫৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আসা রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের চেয়ে ২৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার বেশি চলে গেছে চীনে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রপ্তানি আয়-রেমিট্যান্সের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স এসেছে সাত দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের। পরের অর্থবছর (২০১৮-১৯) তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কিছুটা কমে দাঁড়ায় আট দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আবার বেড়ে হয় ১০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছর তা আরও বেড়ে যায়। এর পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। সবশেষ বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় মিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেশি করছে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য টেক্সটাইল পণ্য। প্রায় ৯০ শতাংশই রপ্তানি আয় আসে এ খাত থেকে। এছাড়া হিমায়িত খাদ্য ও চিংড়ি, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সবজি ইত্যাদিও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়।

অপরদিকে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ১১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। পরের অর্থবছর (২০১৮-১৯) আমদানি আরও বেড়ে হয় ১৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি কমে যায়। ওই অর্থবছর আমদানি হয় ১১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটি থেকে ১২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে অস্বাভাবিক বেড়ে যায় আমদানি। ওই অর্থবছর ১৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার পণ্য আমদানি হয়। সর্বশেষ গত অর্থবছর প্রথম নয় মাসে দেশটি থেকে ১৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়।

গত পৌনে ছয় অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি, তুলা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম ও সেগুলোর যন্ত্রাংশ; সাউন্ড রেকর্ডার এবং রিপ্রডিউসার, টেলিভিশন ইমেজ এবং সাউন্ড রেকর্ডার, সুতা, কৃত্রিম ফিলামেন্ট, প্লাস্টিকের কাঁচামাল, লোহা ও ইস্পাত, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, সার, কাগজ ও কাগজের বোর্ড প্রভৃতি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরর পরিমাণ বেড়ে হয় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর ২ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছর ২ দশমিক ০১  বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর ৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার এবং গত অর্থবছর ৯ মাসে ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের এসব পণ্য আমদানি করা হয়।

এরপর তুলা আমদানি করা হয় বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছর ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর ২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি করা হয়। আর গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আমদানি হয় ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম এবং তার অংশ; সাউন্ড রেকর্ডার এবং রিপ্রডিউসার, টেলিভিশন ইমেজ এবং সাউন্ড রেকর্ডার আমদানি হয়েছে। পরের (২০১৮-১৯) অর্থবছর এ ধরনের পণ্য ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন আমদানি করা হয়। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছর ১ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছর ১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার এবং গত অর্থবছর প্রথম নয় মাসে ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের এসব পণ্য আমদানি করা হয়।

চীন থেকে বাংলাদেশ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬১ কোটি ডলারের সুতা আমদানি করে। পরের অর্থবছর (২০১৮-১৯) ৭৪ কোটি ডলারের সুতা আমদানি করা হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর ৬৭ কোটি ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছর ৮৬ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার এবং গত অর্থবছর প্রথম নয় মাস ১ বিলিয়ন ডলারের এসব পণ্য আমদানি করা হয়।

কৃত্রিম ফিলামেন্ট আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে দেশটি থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৫৮ কোটি ডলারের এসব পণ্য আমদানি করে। পরের অর্থবছরও (২০১৮-১৯) বেড়ে হয় ৭৫ কোটি ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর ৬৬ কোটি ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছর ৮২ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার এবং গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আমদানি হয় ৯৪ মিলিয়ন ডলার।

এদিকে ইপিবির তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে চীনে ৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। পরের অর্থবছর (২০১৮-১৯) রপ্তানি আয় বেড়ে হয় ৮৩ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে চীন রপ্তানি কমে দাঁড়ায় ৬০ কোটি ডলার। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় আবার বেড়ে হয় ৬৮ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর দেশটিতে পণ্য রপ্তানি হয় ৬৮ ডলার এবং গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে হয় ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি।

দেশটিতে বাংলাদেশ রপ্তানি বেশি করছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, অন্যান্য টেক্সটাইল ফাইবার, তৈরি পোশাক, জীবন্ত ও প্রক্রিয়াজাত মাছ প্রভৃতি।