যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের নারী শিশুরা পাচারকারীদের খপ্পরে

জান্নাতুল ফেরদৌস তামান্না: ইউক্রেন ও মলদোভার পালাংকা সীমান্তের কাছে এক নারী তার ১৫ বছর বয়সী ভাগ্নেকে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের দেখে স্পষ্টত অপ্রীতিকর কিছু মনে হয়নি, তবে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের কাছে কিছুটা অদ্ভুত লেগেছিল। বিশেষ করে ছেলেটিকে বেশ বিব্রত দেখাচ্ছিল। সন্দেহজনক হওয়ায়, কর্মকর্তারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন এবং পরে তাদের সমাজকর্মী ও মনোবিজ্ঞানীদের কাছে নিয়ে যান।

‘আমরা বুঝতে পারি, কিছু একটা ঠিক নেই, তবে সেটি কী তা বুঝতে পারিনি। তাই আমরা তাদের আলাদাভাবে তাদের সাক্ষাৎকার নিই,’ মনোবিজ্ঞানী সিএনএনকে একথা বলেন।

ওই নারী ও তার ভাগ্নের গল্পটি সাজানো ছিল। নারীটি ছেলেটির অপরিচিত। ছেলেটিকে ইউক্রেনে বসবাসকারী তার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য সাইপ্রাসে একটি লাভজনক চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। এর জন্য তার ভাগ্নে হওয়ার ভান করা, নারীটিকে তার পাসপোর্ট দেয়া ও তাকে জাল পিতামাতার সম্মতিপত্র লিখতে সাহায্য করার দরকার ছিল।

মনোবিজ্ঞানী সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা তার মাকে খুঁজে বের করে এখানে আসতে বলেছিলাম। তিনি (মা) কাঁদছিলেন এবং বলছিলেন, তিনি কোনো সম্মতিপত্র লেখেননি। এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। বিষয়টি ভয়ানক।’ নিরাপত্তার কারণে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

ঘটনাটি তদন্তের জন্য মলদোভার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান মনোবিজ্ঞানী। এ অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করে জানায়, ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে মানব পাচারের ঝুঁকিতে থাকা নারী ও শিশুদের সংখ্যা আকাশচুম্বী হয়েছে।

পালাংকা সীমান্তে ছেলেটির মা আসায় সে তার পরিবারের কাছে পুনরায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অন্য অনেকে হয়তো এতটা ভাগ্যবান নয়। উদ্বাস্তুদের বিশেষ করে নারীদের লক্ষ্য করে পাচার বেড়েছে। সম্প্রতি ১০ জন গর্ভবতী নারীকে মলদোভায় আবাসনের আবাসনের জাল প্রস্তাব দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়।

লুদমিলা নামে আরেক নারী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেন থেকে পালিয়ে মালদোভায় চলে যান। তিনি সিএনএনকে বলেন, মালদোভার রাজধানী চিসিনাউয়ে মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে পাওয়ার আগে তার তিন সন্তানকে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়। তাদের অ্যালকোহল দেয়া হয় এবং অপরিচিতদের জন্য কাজ করানো হয়।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তার সৈন্যদের ইউক্রেন আক্রমণের নির্দেশ দেয়ার পর ইউরোপজুড়ে স্বেচ্ছাসেবীরা সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা মানুষকে সাহায্যের জন্য ইউক্রেনের সীমান্তে ছুটে আসেন। তখন কিছু মানুষ এ পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বার্থে হাসিলের জন্য কাজ শুরু করেন।

গত মাসে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন সতর্ক করে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে দেশটি থেকে মানব পাচার হচ্ছে, যার শিকারে পরিণত হচ্ছেন নারী ও শিশুরা। তারা নির্যাতিত হচ্ছেন।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার মতে, যুদ্ধ শুরুও পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৯ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছেন। তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী ও শিশু, যাদের বেশিরভাগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির শিকার। তাদের অনেকে পাচার হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। ভাগ্য সহায় হওয়ায় শুরুর দিকে অনেকে পোল্যান্ডে আশ্রয় নিতে পেরেছেন। সংকট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ায় অনেকে ইউক্রেনে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এ সমস্যা আরও বাড়তে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) জানায়, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা মানব পাচারবিরোধী পরামর্শ হটলাইনে প্রায় উনিশ হাজার কল পেয়েছেন। সংস্থার মুখপাত্র জো লোরি বলেন, আমরা জানি, এই দুষ্টচক্র নিরাপদ যাত্রার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ইউক্রেনের শরনার্থীরা মলদোভাসহ যে দেশগুলোয় পালিয়ে যাচ্ছেন সেসব দেশে মানব পাচারের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা রয়েছে বলে জানান তিনি।

ইউনিসেফের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের পর মলদোভায় প্রায় পাঁচ লাখ সত্তর হাজার শরণার্থী এসেছেন। ২০২১ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ‘উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা’ সত্ত্বেও মলদোভা পাচার নির্মূলের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় নীতিমালাগুলো পূরণ করেনি।

যুদ্ধের আগে এই অঞ্চলে পাচারের প্রবণতা ছিল এবং পাচারকারীরা এই সংকটকে পুঁজি করছে। তারা যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘অর্থ’ এখানে মূল বিষয়। মলদোভা ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশ এবং এর সম্পদ সীমিত। দেশটির সীমান্ত কর্মকর্তারা মানব পাচারের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন। দেশটির সীমান্ত পুলিশের পূর্ব অধিদপ্তরের উপ-প্রধান আন্তন জাগোরেস বলেন, তার দল অপ্রাপ্তবয়স্কদের নিজেদের বা তাদের বাবা-মা নয় এমন লোকদের সঙ্গে ভ্রমণ করার অসংখ্য ঘটনা দেখেছে। পাচারের ঝুঁকির কারণে কর্মকর্তাদের সব মামলা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সমাজ কর্মীদের কাছে পাঠাতে হবে, যাতে এই শিশুরা আত্মীয়স্বজন বা পরিবারের বন্ধুদের সঙ্গে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০