আরাফাত রহমান: যুবসমাজ যে কোনো দেশের মূল্যবান সম্পদ। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি যুবসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। যুবসমাজের মেধা, সৃজনশীলতা, সাহস ও প্রতিভাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে একটি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যুবসমাজ জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার, নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। জনসংখ্যার সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ও উৎপাদনমুখী অংশ হচ্ছে যুবগোষ্ঠী। দেশের অসংগঠিত, কর্মপ্রত্যাশী এই যুবগোষ্ঠীকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং উৎপাদনমুখী শক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়াধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শ্রমশক্তির জোগান ও সংখ্যার বিবেচনায়ও আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য যুবসমাজের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং দেশের জনসংখ্যার সম্ভাবনাময়, আত্মপ্রত্যয়ী, সৃজনশীল ও উৎপাদনক্ষম এ অংশকে জাতীয় উন্নয়নের মূল ধারায় অবদান রাখার জন্য তাদের মাঝে গঠনমূলক মানসিকতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী হিসেবে দেশের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার অনুকূল ক্ষেত্র তৈরির উদ্দেশ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে।
কর্মপ্রত্যাশী অনুৎপাদনশীল যুবসমাজকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং উৎপাদনমুখী শক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৮ সালে যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী সময়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনঃনামকরণ করা হয়। মাঠ পর্যায়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ১৯৮১ সালে ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর’ সৃষ্টি করা হয়। বেকার যুবকদের উন্নয়নের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে দেশ গঠনে অংশগ্রহণ বাড়াতে যুবকদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং প্রশিক্ষণ পরবর্তী প্রকল্প গ্রহণকারীদের মাঝে ঋণ প্রদান করা হয়। সৃষ্টিলগ্ন হতে অদ্যাবধি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর দেশের যুবসমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে প্রায় ৩৬ লাখ যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, যাদের অনেকেই দেশে ও বিদেশে সম্মানজনক সামাজিক অবস্থান করে নিতে সক্ষমতা অর্জন করেছেন।
যুবসমাজই একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যুবসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাই অপরিহার্য। যুবসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়নের চিন্তা বাস্তবতা বিবর্জিত। উন্নয়নের রিলে রেসে যুবসমাজই বয়স্কদের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। যুবসমাজ বলবান, আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল শক্তি। তাদের আছে স্বপ্ন, আছে নতুনের প্রতি আসক্তি এবং আশা-আকাক্সক্ষা। তারা চঞ্চল কিন্তু বেগবান। যুবসমাজের আত্মপ্রত্যয় ও গতিময়তাকে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও কাজে লাগাতে পারলে উন্নয়নের গতিপথ হবে পরিশীলিত ও সতেজ। যুবসমাজকে তাই জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে সম্পৃক্ত করা অপরিহার্য।
জাতীয় যুবনীতি অনুসারে বাংলাদেশের ১৮-৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে যুব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ বয়সসীমার জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ; যা আনুমানিক ৫ কোটি। জনসংখ্যার প্রতিশ্রুতিশীল, উৎপাদনমুখী ও কর্মপ্রত্যাশী এই যুবগোষ্ঠীকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়াধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশের জনসংখ্যার সম্ভাবনাময় এ অংশকে জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে গঠনমূলক মানসিকতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা এবং সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী হিসেবে দেশের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার অনুকূল ক্ষেত্র তৈরির উদ্দেশ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর শুরু থেকেই বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে; যার সুফল ইতোমধ্যে জাতীয় কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যুব উন্নয়নের জন্য সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যুবনিবাস এবং যুবকল্যাণ কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুবকদের জন্য কিছু সীমিত সমাজকল্যাণ সম্পৃক্ত সেবা প্রদান করে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে যুবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে থানা সম্পদ উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান প্রকল্প শিরোনামে একটি নতুন প্রকল্প ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে ৭৬০ মিলিয়ন টাকার অধিক বাজেট বরাদ্দ নিয়ে শুরু হয়। তৃতীয় পরিকল্পনাকালে যুব উন্নয়ন কার্যক্রমের অধীনে ৪৩ হাজার ৯৩৫ জন বেকার যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এবং পরিকল্পিত সময়ের শেষে ৯৭ দশমিক ৭০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যুব উন্নয়ন কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠনের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং সমাজ উন্নয়নের পরিকল্পনা করে। এসব কার্যকলাপ বাস্তবায়নের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। পরিকল্পিত সময়ে বিভিন্ন পেশায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭০১ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এবং ৩ লাখ ৪ হাজার ৩৮৮ জন প্রকৃতপক্ষে প্রশিক্ষিত হয়। প্রশিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা সম্প্রসারণ করাই ছিল ওই সময়ের যুব উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় ৩২ উপজেলায় এটি বিস্তৃত করা হয়। সুফলভোগীদের মোট সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯২ হাজার এবং এদের প্রত্যেককে ক্ষুদ্রঋণ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়। পরিকল্পিত সময়ের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ১২৫ কোটি টাকার ঋণ তহবিল নিয়ে ৫০টি নির্বাচিত উপজেলায় পরিবারভিত্তিক কর্মসংস্থান কার্যক্রম গৃহীত হয়। গ্রামের যুবকদের পশুপালন, মৎস্যচাষ ও বৃক্ষরোপণে প্রশিক্ষণ এবং সাক্ষরতা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পরিবার কল্যাণ, পরিবেশ উন্নয়ন, সম্পদ সংরক্ষণ প্রভৃতি সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আবাসিক ভিত্তিতে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বিস্তৃত করা হয় ৬ থেকে ১০ জেলায়।
যুব উন্নয়ন কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে উদ্বুদ্ধকরণ, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান জোগানোর মাধ্যমে যুবকদের লাভজনক আত্মকর্মসংস্থান গ্রহণে উৎসাহদান, কর্মদক্ষতায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য সুযোগ-সুবিধা বিস্তার এবং কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাগত ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যুব উন্নয়ন কার্যক্রমে বরাদ্দ ছিল ৬২৮ কোটি টাকা। যুব উন্নয়ন কার্যক্রম এখন ৪৮০ উপজেলায় বিস্তৃত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের বেকার যুবকদের পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন এবং মৎস্য চাষে আবাসিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
তিনশ’রও বেশি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতি বছর বিভিন্ন পেশায় ২ লাখ ৫০ হাজার জন বেকার যুবককে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বৃত্তিগুলো হচ্ছেÑকম্পিউটার, বৈদ্যুতিক তার সংযোগকরণ, রেফ্রিজারেশন, গৃহাদির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, বৈদ্যুতিক উপকরণ মেরামত প্রভৃতি। যুবসংঘের মাধ্যমে বিভিন্ন আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এসবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে গ্রামের নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহারের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ১৯৮১ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০০৮ মেয়াদে প্রায় ৩১ লাখ যুবক ও যুবমহিলাকে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বেকার যুবদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করে তাদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য কাজ করছে। তাদের কর্মস্পৃহা এবং কর্মোদ্দীপনা কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এই দলভুক্ত বয়সের একটি বড় অংশ গ্রামে বাস করে। যুবকরা জনসংখ্যার এক কর্মকুশল অংশ এবং সংগঠিত যুবকরা সমাজে আনতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। যুবকদের কল্যাণ এবং পথনির্দেশনা ও শিক্ষাদান, প্রশিক্ষণ ও চাকরিদান এসবই যুব উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শ্রমশক্তির সবচেয়ে উদ্যমী, সৃজনশীল, গতিশীল এবং উদ্ভাবনীমূলক অংশ এই যুবগোষ্ঠী অতীতে বিশেষ শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় সরকার এক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেনি। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সরকারের যুব উন্নয়ন কার্যক্রমে লাভজনক কর্মসংস্থান এবং আয় সৃষ্টির সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেকারদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। দেশের মোট যুবকদের প্রায় অর্ধেকই দারিদ্র্যহেতু এবং যথেষ্ট দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে বেকার বা অর্ধনিয়োজিত বলে ধারণা করা হয়। সুতরাং বেশিরভাগ যুবক অবস্থান করে যুব উন্নয়ন কাঠামোর মূলধারার বাইরে। বাংলাদেশ সরকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য দক্ষতা সৃষ্টি এবং কিছু ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
এ লক্ষ্য তাদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে অত্যন্ত সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য দেশের সব জেলা ও উপজেলায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া দেশের ৬৪টি জেলায় আবাসিক ও অনাবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। তদুপরি দেশের সব উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে আবাসিক ও অনাবাসিক এবং স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বেকার যুবরা কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ,
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়