Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:02 pm

যেখানে ঘুমায় মেঘ…

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং খাসিয়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠে অন্য পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হবে প্রায় এক হাজার ৫০০ ফুট সুউচ্চ পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘগুলো ঘুমিয়ে আছে। নড়াচড়া নেই। শিশুরা যেমন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকে ঠিক তেমনি। এ দৃশ্য উপলব্ধি করা সম্ভব কেবল স্বচক্ষে। নতুবা কাউকে বিশ্বাস করানো বা বোঝানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
মেঘালয়ের নামকরণ হয়েছে মূলত পাহাড় ও মেঘের কারণে। কেউ কেউ বলেন, মেঘের বাড়ি অর্থাৎ ‘মেঘের আলয়’ থেকেই এসেছে ‘মেঘালয়’ নামটি। আসলেই তা-ই। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের খাসিয়া পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া জলপ্রপাতের পানি নদীতে ছুটে চলার পর আবারও তা মেঘ হয়ে ওই পাহাড়ের বুকে ফিরে আসে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! নিজের চোখে না দেখলে এর অনুভূতি বোঝানো সম্ভব নয়।
সেভেন সিস্টারস-খ্যাত উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য মেঘালয়। পাহাড়, ঝরনা, বৃষ্টিস্নাত সবুজ প্রকৃতি প্রভৃতি মিলে প্রকৃতি যেন আরেক স্বর্গ রচনা করেছে এখানে। বছরে ছয় থেকে সাত মাস মেঘালয় মেঘে ঢাকা থাকে। মেঘেদের খেলাঘর এ রাজ্যটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে। আমরা যারা পাহাড় ও ঝরনা দেখতে খুব ভালোবাসি, তাদের জন্য এ রাজ্যটি হতে পারে একটি পরিতৃপ্তির জায়গা।
সিলেটের তামাবিল সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে শিলং শহর। এছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসীর জন্য নতুন একটি রুট হয়েছে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার নাকুগাঁও-ভারতের ঢালু সীমান্ত দিয়ে। এ সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে মেঘালয়ের তুরা শহর। এখান থেকে সকাল ও রাতে আসামের পাইকান-গোয়াহাটি হয়ে শিলং যাওয়ার চমৎকার রাস্তা রয়েছে। এ সীমান্ত দিয়ে শিলংয়ের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার হলেও তুরা, পাইকান ও গোয়াহাটি হয়ে মেঘ-পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য অবলোকন বাড়তি আনন্দ দেবে ভ্রমণকারীকে।
সম্প্রতি আমরা তিন বন্ধু গিয়েছিলাম এ সীমান্ত দিয়ে। শেরপুর থেকে সিলেট হয়ে শিলংয়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। বাড়ির পাশেই সীমান্ত। তাই সকাল ৮টায় বেরিয়ে পড়ি। সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে নাকুগাঁও-ঢালু সীমান্ত পার হয়ে তুরা শহরে পৌঁছি দুপুরের মধ্যে। সেখানে গিয়ে সন্ধ্যার বাসের টিকিট না পাওয়ায় পরের দিনের ভোরের টিকিট কেটে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে হোটেলে ফিরি। পাহাড়ি এলাকা বলে সন্ধ্যার মধ্যে প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।
পরদিন ভোরে উঠে ৫০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ১৪ সিটের মাইক্রোবাসে চেপে বসি। এখান থেকে ভালো মানের বাসও রয়েছে। ভাড়া ৩০০ টাকা। সকাল ১০টায় আসামের পাইকান ও বেলা ১টায় গোয়াহাটিতে প্রায় এক ঘণ্টা সময়ের পৃথক দুটি স্টপেজ দিয়ে বেলা ৩টার মধ্যে শিলংয়ে পৌঁছে যাই। সেখানে পৌঁছে হোটেলের সন্ধানে বেশ সময় লেগে যায়। কারণ এ শহরে পুলিশ বাজার এলাকায় বিদেশিদের রাত যাপনের অনুমোদন সব হোটেলে নেই। তাই ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকটি হোটেল দেখে অবশেষে একটি হোটেল পেয়ে যাই। এ হোটেল খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা হওয়ায় সেদিন কোথাও বেড়ানো সম্ভব হয়নি।
সন্ধ্যায় পুলিশ বাজারের চৌরাস্তা মোড়ে জম্পেশ আড্ডায় মেতে উঠি স্থানীয় ও দেশ-বিদেশের পর্যটকদের সঙ্গে। এ সময় পাহাড়ে গা থেকে আসা হিমেল হাওয়া মনে অন্যরকম শিহরন জাগায়।
পরের দিন সকাল ৮টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। তুরার এক গারো বন্ধুর সহযোগিতায় শিলংয়ের মাইকেল নামে এক সাবেক এমএলএ’র ব্যক্তিগত গাড়িতে ছুটে চলি মেঘ-বৃষ্টির খেলা দেখতে চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে। কিন্তু মাইকেল ভাইয়ের অপর সঙ্গী স্থানীয় ব্যবসায়ী ফ্রান্সিস ভাই নিয়ে যান বাংলাদেশের ডাউকি সীমান্তের কাছে। এখানে গাছের ওপর একটি স্পট রয়েছে ‘বাংলাদেশ পিক’। এখানে উঠে বাংলাদেশের সিলেটের তামাবিল দর্শন করে দেশের স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলি। ওই বাংলাদেশ চূড়ায় উঠে মজার দৃশ্যের পাশাপাশি দেশের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক পাওয়া অনন্য অভিজ্ঞতা, সুখানুভূতি কাজ করে তখন।
পরে চলে আসি এশিয়া মাহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন গ্রাম খাসিয়া পল্লি মাওলিনংয়ে। এখান থেকে ট্রি ব্রিজ। প্রাকৃতিকভাবে একটি ঝরনার ওপর গাছের মূল ছড়িয়ে তৈরি হয়েছে ব্রিজটি। এ ব্রিজ দিয়ে পারাপার ও ব্রিজের নিচে ছুটে চলা ঝরনার কলকল শব্দ অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি করে। তবে এখানে যেতে চাইলে পরিশ্রম করতে হবে। কারণ ওই ঝরনার কাছে যেতে কমপক্ষে ১০০ ফুট নিচে নামতে হবে সিঁড়ি বেয়ে। আবার উঠতে হবে ওই একই পথে।
এই লম্বা ভ্রমণের সময় মাঝেমধ্যে মেঘ যখন আমাদের গাড়ির ওপর আছড়ে পড়ছিল, তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি আমরা কেউই। গাড়ি থেকে বেরিয়ে মেঘ ধরার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি। আমরা যেভাবে এদেশে মেঘ দেখি, ওখানে ওই মেঘ সে রকম নয়। অনেকটা কুয়াশার মতো দেখা যায়। সে কুয়াশা মেঘ হয়ে আলতো করে যখন আমাদের ছুঁয়ে ভিজিয়ে দিল, তখন মনে হলো এ যেন স্বর্গের পরশ।
সেদিন আমাদের কপাল মন্দ ছিল। ভ্রমণ শেষে বিকালের দিকে চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে যাত্রা করতেই বাদ সাধে ঘন মেঘ আর বৃষ্টি। এ ধরনের ঘন মেঘের দেখা সবসময় পাওয়া যায় না। দেখা মিললেও তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তা অতিক্রম করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। তাই আমরা চেরাপুঞ্জির মূল পয়েন্টের মাত্র দুই কিলোমিটার কাছ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হই।
মজার বিষয় হলো, মাত্র পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে গেলেই মেঘ চলে যায়। দূর পাহাড়ে সূর্যের হাসি দেখতে পাই। আবার কিছু দূর এগুতেই ফের বৃষ্টির মুখে পড়ি। এই মেঘ, এই বৃষ্টি, এই রোদ্দুরÑসব মিলিয়ে শিহরন জাগানিয়া অনুভূতি।
অবশেষে সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে ফিরে আসার কারণে শিলংয়ের অন্যতম আকর্ষণীয় ‘শিলং পিক’ দেখা হলো না। তাই শর্টকাট পথ বেছে নিই। এলিফ্যান্ট ফলস্ বা হাতির ঝরনা দেখে তুরার উদ্দেশে শিলং থেকে সন্ধ্যায় বাসে চড়ে বসি এবং ভোর ৪টায় তুরায় এসে ওই স্থানীয় গারো বন্ধুর বাসায় উঠি। এখানে একটি লম্বা ঘুম দিয়ে পরদিন দুপুরে উঠে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুরার বিভিন্ন স্থান দর্শন করি। কিছু কেনাকাটা করে আবার ফিরে আসি ওই বন্ধুর বাড়িতে। এখানে রাতযাপন করে পরদিন সকালবেলা মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তের নাকুগাঁও হয়ে নিজের শহরে পৌঁছি বেলা ২টার মধ্যে।
ঢাকা থেকে মেঘালয় বা শিলং যাওয়ার সহজ উপায় হলো ঢাকা থেকে সিলেট। এরপর সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ে প্রবেশ করা যায়। তবে বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসীর জন্য শেরপুরের নাকুগাঁও-ঢালু সহজ ও রোমাঞ্চকর রুট।
মেঘালয়ে সারা বছর পর্যটকদের আগমন ঘটে। তবে এখানে পিক ও অফ পিক সিজন হলো মার্চ মাস থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি ও সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি। পিক সিজনে শিলংয়ের আসল রূপ দেখা যায়। বিশেষ করে হাত দিয়ে মেঘ ছোঁয়া যায়। এ সময় প্রচুর পর্যটক এখানে বেড়াতে আসে। তাই সবকিছুর দাম তুলনামূলকভাবে চড়া থাকে। যেমন ভ্রমণ খরচ, হোটেল ভাড়া, খাবার খরচ প্রভৃতি বেড়ে যায়।
শিলংয়ে পর্যটকদের থাকার হোটেলগুলোর অধিকাংশই বড়বাজার ও পুলিশ বাজার কিংবা তার আশপাশে অবস্থিত। তবে পুলিশ বাজার তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয়, কারণ এখান থেকে সহজে বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটে যাওয়ার গাড়িগুলো পাওয়া যায়। শিলংয়ের হোটেলগুলোয় আপনি দিনপ্রতি ৮০০ থেকে ১০ হাজার রুপির মধ্যে কক্ষ পাবেন। শিলংয়ের হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইডেন রেসিডেন্সি, হোটেল ব্রডওয়ে শিলং, হোটেল আল পাইন কন্টিনেন্টাল, দ্য মাজেস্তিক হোটেল প্রভৃতি।
শিলংয়ে বেশ ভালো মানের কয়েকটি খাবারের হোটেল রয়েছে। এ হোটেলগুলোয় মাছ, মাংস, লুচিসহ নানা স্থানীয় ও চাইনিজ খাবার পাওয়া যায়। তবে যারা হালাল-হারাম চিন্তা করে খাবার খেয়ে থাকেন, তারা একটু যাচাই-বাছাই করে খাবেন। কারণ খাসিয়াদের অন্যতম প্রিয় খাবার হচ্ছে শূকরের মাংস। শিলংয়ের কিছু খাবার খুবই জনপ্রিয়, যার স্বাদ আপনিও নিতে পারেন। এ খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে পুলিশ বাজারের দিল্লি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জিলাপি, ইসি রেস্তোরাঁর কিমা সমুচা, চাউমিন প্রভৃতি।
পর্যটকদের মন হরণ করে নেওয়ার মতো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। মাওলিনং, ডাবল ডেকার জীবন্ত সেতু, এলিফ্যান্ট ফল্স, বালপাকরাম ন্যাশনাল পার্ক, ইউমিয়াম লেক, মাউসমাই গুহা, সিজু গুহা, নহখালিকাই ফলস, সেভেন সিস্টার্স ফলস প্রভৃতি। শিলংকে ভালোভাবে দেখার জন্য অবশ্যই সাত দিন হাতে থাকা চাই।
পুলিশ বাজার মোড় থেকে দর্শনীয় স্থানগুলোয় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন গাড়ি পাবেন। এখান থেকে প্রতিদিন বাসে কম খরচে পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এজন্য আগে থেকে টিকিট কেটে রাখতে হবে। সুবিধার জন্য সঙ্গে একজন টুরিস্ট গাইড রাখতে পারেন।
একজন টুরিস্ট হিসেবে প্রথমেই যা সবসময় সঙ্গে রাখা উচিত তা হলো পাসপোর্ট ও ভিসা। কারণ পুলিশ যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে আপনার পাসপোর্ট-ভিসা দেখতে চাইতে পারে। এছাড়া যেহেতু মেঘের রাজ্য, সুতরাং ভিজতে না চাইলে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম, যেমন ছাতা, রেইন কোর্ট প্রভৃতি সঙ্গে রাখুন। কিছু মানুষ আছে যাদের উঁচুতে উঠলে কানে তালা লাগাসহ মাথাব্যথা হয়। এজন্য মাথাব্যথা কমানোর ট্যাবলেট রাখতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, সঙ্গে খাবার পানি নিতে ভুলবেন না।
মেঘালয়ের স্থানীয় অধিবাসীরা পর্যটকদের প্রতি আন্তরিক হলেও কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়াবেন না। হালাল-হারাম চিন্তা করে যারা খাবার খান, তারা বুঝে-শুনে খাবার খাবেন। সকাল সকাল ঘুরতে বের হয়ে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসুন। সঙ্গে মোবাইল ফোন ক্যামেরা প্রভৃতি সাবধানে রাখুন।

রফিক মজিদ