যেমন হলো ছাত্র বসন্ত

মেজবাহ হোসেন: সাবেক সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমেদ ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে বাংলাদেশ বন্ধক রেখে নিজের চাকরি নিশ্চিত করেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা অবলুপ্ত, যার সূচনা হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব থেকে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও চৌকস ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংস ও নারকীয়ভাবে হত্যার মাধ্যমে। তারপর একে একে সাংবাদিক দম্পতি হত্যা, জামায়াত নেতাদের সরকারি নোটে ফাঁসি দেয়া, নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডার, শাপলা চত্বরে আলেম গণহত্যা, ইলিয়াস আলী গুম ও হত্যা, সালাউদ্দিন আহমদ গুম, ব্রিগেডিয়ার আজমী ও ব্যারিস্টার আরমানকে নিয়ে আয়নাঘরে গুম করে রাখা, বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ মামলায় সাজা দিয়ে তাকে প্রাপ্য জামিন না দেয়া, আর অবশেষে মাওলানা মামুনুলকে বিয়ে করার অপরাধে জেলে বন্দি রাখা।

রাজনৈতিক এই নারকীয়তার পাশাপাশি জনগণকে ভীতি প্রদর্শন ও শায়েস্তা করতে নিত্যনতুন কালো আইন প্রণয়ন আর সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও যুবলীগ দিয়ে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন ও অপমান যেন রোজকার রুটিন কাজ। এই দীর্ঘশ্বাস, এই অন্যায়, অপশাসন ও দুর্নীতি থেকে মানুষ মুক্তির জন্য যখন তীর্থের কাকের মতো সৃষ্টিকর্তার কৃপা চাইতে থাকে, তখন দীর্ঘ ১৫ বছর পরে সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ এসে উপস্থিত হয় আমাদের মাঝে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক সফল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। গত সোমবার বেলা দেড়টা নাগাদ ভারতের পোষ্য ফ্যাসিস্ট হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, যা ওই দিনই প্রায় বেলা ৩টা নাগাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই অভ্যুত্থানের নায়ক আমাদের ছাত্ররা, যত প্রাণ তারা উৎসর্গ করেছে, যত রক্ত রাজপথে ঝরেছে, সেই বিবেচনায় বাংলা বসন্তের চেয়ে ছাত্র বসন্তই এই অভ্যুত্থানের অধিকতর সফল ও সার্থক নাম হওয়ার দাবি রাখে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের যেই আন্দোলন চলতি বছরে জুলাইয়ে শুরু হয়, তার বীজ বপন করেছিল ফ্যাসিবাদের পদলেহী হাইকোর্ট এক বাহুল্য নির্দেশনা জারি করার মাধ্যমে, যার এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে কোটা নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই, তবে একটি ক্লজে বলা আছে, প্রয়োজনে যেকোনো অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য নির্বাহী বিভাগ চাইলে কোটার ব্যবস্থা করতে পারে। ২০১৮ সালের নুরদের নেতৃত্বে যেই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতে হাসিনা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে সব সরকারি চাকরিতে কোটা পুরোপুরি বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। ছাত্ররা তখন চেয়েছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার, কিন্তু পেয়ে গেল কোটা সম্পূর্ণ বাতিল; ফলে সবাই খোশ মেজাজে ফিরে গেল ক্লাসে। ছাত্ররাও ঠাণ্ডা, হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনও ঠাণ্ডা। ফলে এই কোটা বাতিলের সুফল কিন্তু হাসিনাও পেয়েছে। হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকলেও সেটা সব সময় পূরণ হতো না, ফলে অপূরণ থাকা পদে মেধা থেকে নিয়োগ দেয়া হতো। উল্লেখ্য, তখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা কেবল সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য ছিল, নাতিপুতির জন্য নয়।

কিন্তু হাসিনা ক্ষমতায় এসে এই বিষয়টা দেখে নাতিপুতিকেও কোটার মধ্যে সংযুক্ত করে, যাতে এই কোটা পুরোপুরি পূরণ করা যায়। আওয়ামী লীগ আমলে প্রায় লাখ খানেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে সনদ দিয়ে তাদের ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিকে হাসিনা তার ক্ষমতার হাতিয়ার করার ফন্দি প্রায় সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়। এই বিশালসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতি স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তি আর সব শেষে বিসিএস-সহ সব সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে। খুব সূক্ষ্মভাবে একটা বিশালসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে পলিটিকাল গ্রুমিং করে বড়
করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে; ফলে তাদের কাছে ন্যায়নীতি, দেশ, জাতীয় স্বার্থ এমনকি পাপবোধের ওপরে হাসিনার স্বার্থ প্রধান হয়ে ওঠে। ঠিক সেই প্রক্রিয়া যেখানে আপনি একটা পোষা প্রাণীকে গ্রুমিং করার ফলে সে আপনার বাধ্যগত থাকে বা বেইমানি করে না (যেমন: পাখি, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি)। ব্যাংকিং সেক্টরে যে নৈরাজ্য হলো, হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হলোÑএর পেছনে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিশেষ নিয়োগকে আমি অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করি। তারা জুনিয়র পদে কর্মরত থাকলেও তাদের দায় অনেক। এই বিশালসংখ্যক ব্যাংকার তারা ব্যাংকিং সেক্টরের নৈরাজ্য আর টাকা পাচার
নিয়ে চুপ থেকেছে, কোনো প্রতিবাদ করেনি। যেহেতু স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের চাকরি পাওয়া কঠিন ছিল, আর হাসিনা তাদের ফেভার দিয়েছে জীবনের প্রতিটি ধাপে, তাই হাসিনার কাজে তারা ন্যূনতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তারা যদি আওয়াজ তুলত, তাহলে এসবের লাগাম অনেকখানি
টানা সম্ভব হতো।

কী ভাবছেন, শেখ হাসিনার মাথায় এত বুদ্ধি? হাসিনা বা তার দলের কারও মাথায় এর সিকি বুদ্ধিও নেই যে, এরকম একটা ডিপ থট প্ল্যান করবে, এই বুদ্ধির আর অজিত দোভালদের যারা হাসিনাকে এত দিন টিকিয়ে রেখেছিল (লক্ষ করে থাকবেন শেখ হাসিনার পতনের জন্য কীভাবে অজিত দোভালকে দায় দেয়া হচ্ছে)। কিন্তু মাথামোটা হাসিনা কারও সঙ্গে আলাপ না করে বা কারও পরামর্শ না নিয়ে মেজাজ হারিয়ে একা-একাই কোটা বাতিল ঘোষণা করেন। ফলে ২০১৮ সালের পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয়, যেমন পুলিশের এসআই, বিসিএস পুলিশ, প্রশাসনসহ অনেক পদে আর গ্রুমিং করা দলীয় ক্যাডার নিয়োগ দেয়া সম্ভব ছিল না, যারা অন্ধভাবে হাসিনার নির্দেশ পালন করবে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। ২০২৪ সালের নির্বাচনে এই কমতি যখন ভালোভাবে অনুভূত হলো তখন হাসিনা হাইকোর্টের মাধ্যমে তার ভুল শোধরানোর পরিকল্পনা হাতে নেন।
আন্দোলনের কথায় আসা যাক। শুরুতে এই আন্দোলন কেবল ছাত্রদের ছিল, ছাত্রলীগ বা পুলিশ কেউই সেভাবে নিপীড়ন করেনি।

কিন্তু হাসিনা মেজাজ আর মুখের খেই হারিয়ে (যেটা তিনি সব সময়ই হারান) যখন শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে ব্যঙ্গ করলেন, তখন শিক্ষার্থীদের পক্ষে শেখ হাসিনাকে আর সম্মান দেখিয়ে কথা বলা সম্ভব হলো না, তারাও পাল্টা হাসিনাকে স্বৈরাচার বলার সাহস করল। কিন্তু এই তল্লাটে গত ১৫ বছরের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারীর পক্ষে শিক্ষার্থীদের এহেন ‘স্পর্ধা’ বরদাস্ত করা অসম্ভব ছিল। তাই শেখ হাসিনা তার বুলডগ বাহিনী তথা সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর নারকীয় অত্যাচার ও হামলা চালান। লাঠিসোটা, চাপাতি, রডের পাইপ, গরু জবাই করার চাকু, হাতুড়ি, শটগান ও পাইপগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যা করে ও আহত করে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা পলায়নপর না হয়ে লাঠি হাতে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে রুখে দেয় এবং ধাওয়া দিয়ে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া করে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এতে হাসিনা তার দলীয় সন্ত্রাসীদের ওপর আস্থা হারিয়ে পুলিশ লীগের ওপর ভর করেন। পুলিশ লীগ বলার কারণ হলো দলীয় বিবেচনায় নিয়োগকৃত ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডারদের সবাইকে মোটামুটি ঢাকায় রাখা হয় রাজধানী নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ছাত্রলীগ আন্দোলন দমাতে গিয়ে উল্টো ক্যাম্পাস ছাড়া হলে পুলিশ শুরু থেকেই আন্দোলনকারীদের ওপর ওভার ডোজ বল প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে রাতের আঁধারে শিক্ষার্থীদের ওপর উš§ত্ত লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে অসংখ্য হতাহত করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটায়। পুলিশের পাশাপাশি সাভার-আশুলিয়া থেকে প্রচুরসংখ্যক সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে আনা হয় শিক্ষার্থীদের দমন করতে। এসময় সাভার এলাকায় অবস্থিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। তারপর দিনরাত একই কায়দায় পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হানা দিয়ে ছাত্রদের ক্যাম্পাস ছাড়া করে, এসময় ব্র্যাক, নর্থ সাউথসহ অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে উত্তরা ও বাড্ডা এলাকায়। খুব অবাক করা একটা বিষয় যে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিদেশি হয়েও ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছেন; কিন্তু ঢাবি ও জাবির ভিসিরা পুলিশকে তাণ্ডব চালানোর অনুমতি দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। কী নির্মম, কী নিষ্ঠুরÑতারা আমাদের শিক্ষক, আমাদের অভিভাবক! ড. আসিফ নজরুলসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক শুরু থেকেই ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। তাদের এই দাঁড়ানোর বিষয়টি পুরো জাতিকে অনেক শক্তি ও মনোবল জুগিয়েছে।

হামলা থেকে বাদ যায়নি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। এ সময়ে নিরস্ত্র বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ছাত্র আবু সাইদকে পুলিশ গুলি করে শহিদ করে, ঢাকাসহ পুরো দেশে এতক্ষণে শহিদ ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। ওই সময়কার দুটি প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও পাইনি। প্রথমত, পুলিশ ঢাকা ছেড়ে কেন প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর ক্র্যাক ডাউন করার সিদ্ধান্ত নিল। দ্বিতীয়ত, বরিশালে ঠিক কী কারণে পুলিশ শুরুতেই পক্ষ ত্যাগ করল? এই দুটি প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হবে। পরিস্থিতি আরও উত্তাল হলে সারাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও সব ইন্টারনেট বন্ধ করে সমন্বয়কদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে অস্ত্রের মুখে যখন আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা আদায় করা হয়, তখন আন্দোলন একরকম পড়েই যায়। দেশের মানুষের পাশাপাশি আমরা প্রবাসীরাও তখন হতাশার সাগরে ডুবে যাই। ভেবেছিলাম এই আন্দোলন দমে গেল, আমাদের ছাত্র-যুবকদের এখন খুঁজে খুঁজে হত্যা করবে হাসিনার পুলিশ আর ছাত্রলীগ (আন্দোলন ব্যর্থ হলে আমরা সেই পরিণতির দিকেই যেতাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই)।

কিন্তু এক দিন পরেই আপিল বিভাগের রায়কে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্ররা ফিনিক্স পাখির মতো দুর্বার গতিতে সংগঠিত হওয়া শুরু করলে পুরো জাতি আবার প্রাণ ফিরে পায়, বুকে আশার সঞ্চার হয়। এবার আমরা বিজয় মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম, শুধু নিশ্চিত ছিলাম না যে ঠিক কত প্রাণের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছি। হাসিনার তাণ্ডবলীলা আর ছাত্রদের লাশের সংখ্যা দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল। এ পর্যায়ে বিশ্ব হাসিনার নির্মমতার সর্বোচ্চ মাত্রার সাক্ষী হলো। নিজের মানুষকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি, সুউচ্চ ভবনের ছাদ থেকে স্নাইপার দিয়ে গুলি, বন্ধুর কোলে আহত বন্ধুকে গুলি করে হত্যা, বন্ধুর কোলে বন্ধুর লাশ, গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়া হয়, শহিদ সন্তানের মুখে মুখ দিয়ে এক মায়ের সিপিআর দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা, নির্মিতব্য ভবনের কার্নিশে ঝুলন্ত পলায়নপর ছাত্রকে গুলি করে হত্যা, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা এক ছাত্রকে এপিসি থেকে যেভাবে অসম্মান করে টেনে-হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা করার জন্য পৃথিবীতে কোনো ভাষা নেই; শুধু বুক দিয়ে এই কষ্ট এই নির্মমতাকে অনুভব করা যায় মাত্র।

পুলিশ এখন অনেক ক্লান্ত, তারা আর আগের মতো গুলি করছে না, কম আক্রমণাত্মক। কিছু পুলিশ জনতার হাতে মারা পড়ায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে এরই মধ্যে। সেনা নামানো হলো কারফিউ দিয়েÑ‘শুট অ্যাট সাইট’ নির্দেশনা। হ্যাঁ, হাসিনার নির্দেশ যেন ছাত্রদের দেখামাত্র গুলি করা হয়! কিন্তু অনেক দেরিতে হলেও সেনাবাহিনীর হুঁশ ফিরেছে, তারা একটি-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া গুলি ছোড়েনি, হত্যা করেনি। দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর পর ছাত্র-জনতা-সেনার এক অপার মেলবন্ধন দেখা গেল। এর পুরো কৃতিত্ব সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারকেই দিতে হবে। তার নির্দেশনা ছিলÑ‘মাল নয়, আগে জানের হেফাজত করতে হবে। দুর্বৃত্তদের রুখে দিতে হবে। ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ ফলে হতাহতের সংখ্যা কমতে শুরু করে, ছাত্র-জনতা আর সেনাবাহিনীর দখলে যায় রাজপথ। ছাত্ররা ঢাকায় মার্চ করে ৬ আগস্ট গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু এই পুরো আন্দোলনে সব থেকে বড় টুইস্ট সমন্বয়করা ঘটিয়ে ফেলে গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট ঘোষণা দিয়ে।

এতে করে হাসিনা ঘাবড়ে যান, পর্যাপ্ত প্রতিরোধ পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ পান না। তড়িঘড়ি করে আবারও কারফিউ জারি করলেও সারাদেশ থেকে মানুষের ঢল আসতে শুরু করে ঢাকায়। তারা কারফিউ ভেঙে ঢাকায় প্রবেশ করে এবং গণভবন অভিমুখে এগোতে থাকে। হাসিনা সেনাপ্রধানকে অনেক চাপ দেন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখতে; কিন্তু সেনাপ্রধান হাসিনার পক্ষ ত্যাগ করে ছাত্রজনতার কাতারে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। হাসিনা পালিয়ে গেলে ছাত্রজনতার বিপ্লব প্রাথমিকভাবে বিজয় লাভ করে, দেশ রক্ষা পায় এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্টের হাত থেকে। কিন্তু হাসিনার প্রভুর এজেন্ট আর ফেলে যাওয়া আওয়ামী লীগ শুরু করে হামলা, লুটপাট এবং হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যা। উদ্দেশ্য, বিশ্বকে দেখানো
যে বাংলাদেশ হাসিনার আমলেই ভালো ছিল! ভারতের কলকাতার অনেক বাংলা টিভি চ্যানেলে ছাত্রজনতার এই বিজয়কে ‘তারেক রহমান ও মৌলবাদীদের বিজয়’ বলে প্রচারণা চালানো হয়। অন্যদিকে জেনারেল ওয়াকার অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের পক্ষে থাকলেও হাসিনার একান্ত অনুগত কিছু জেনারেল প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে ক্ষমতা লুণ্ঠনের ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

কিন্তু সব পক্ষের সতর্ক দৃষ্টি আর কিছু কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যর্থ করে দিয়ে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সব পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ছাত্রজনতার বিপ্লব পূর্ণতা লাভ করে। অভিনন্দন বাংলাদেশ, অভিনন্দন বিপ্লবী ছাত্রসমাজ, অভিনন্দন ড. ইউনূস, অভিনন্দন বাংলাদেশের নতুন সরকার। ফ্যাসিবাদের উš§ত্ততা কাটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলুক সুস্থতার পথে, সমৃদ্ধির পথে। বাংলাদেশের তারুণ্যের জয়ধ্বনি কম্পিত করুক পুরো বিশ্বকে।
তবে দুটি বিষয় আমরা যেন ভুলে না যাই। প্রথমত, যেসব মহাপ্রাণ অকালে ঝরে গেছেন আমাদের এই বিপ্লব সফল করতে গিয়ে, সেসব বীর শহিদের কথা; দ্বিতীয়ত, আমাদের এই বিপ্লব ব্যর্থ হলে আমাদের যে ধরনের পরিণতি বরণ করতে হতো, সেটি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০