Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:21 am

যেসব ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিল বাধ্যতামূলক

কামরুল হাসান নূর:‘অর্থ আইন ২০২২’-এ ৪০টি সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এত দিন যেসব সেবার ক্ষেত্রে শুধু টিন (ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন সার্টিফিকেট) জমা দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল, সেসব সেবার ক্ষেত্রে এখন রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বলতে আয়কর রিটার্নের প্রাপ্তিস্বীকারপত্র, নাম, টিন ও করবছর উল্লেখপূর্বক সিস্টেম জেনেরাটেড সার্টিফিকেট অথবা উপকর কমিশনারের সার্টিফিকেটÑএই তিনটির যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য হবে।

ক্রেডিট কার্ড, জমি ক্রয় বা এমন অনেক কারণেই অনেকেই টিন খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু তার করযোগ্য আয় না থাকায় এত দিন আয়কর রিটার্ন জমা করেননি। তাদের রিটার্ন জমাটা সহজ করতে করদিবসে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যক্তিগত করদাতা যারা কখনোই আয়কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের জন্য করদিবস ৩০ নভেম্বরের পরিবর্তে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা আগামী বছর ৩০ জুনের আগে যেকোনো সময় রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।

যেসব ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে, সেই খাতগুলোর নাম ‘আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪’-এর ধারা ‘১৮৪এ’-এর ‘উপধারা-৩’-এ উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন লাইসেন্স গ্রহণ, ব্যাংকিং সেবা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে।

যেসব সরকারি লাইসেন্স, অনুমোদন ও সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলো হলোÑআইআরসি অথবা ইআরসি গ্রহণ, সিটি করপোরেশন অথবা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ, কোঅপারেটিভ সোসাইটির নিবন্ধন গ্রহণ, সাধারণ বিমার সার্ভেয়ার হিসাবে লাইসেন্স গ্রহণ, নিকাহ নিবন্ধক হিসাবে লাইসেন্স গ্রহণ, ড্রাগ, ফায়ার, পরিবেশ এবং বিএসটিআই’র লাইসেন্স গ্রহণ, যেকোনো নৌযানের জন্য সার্ভে সার্টিফিকেট গ্রহণ, ইট তৈরির অনুমতিপত্র গ্রহণ, সিটি করপোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাস সংযোগ অথবা অন্য যেকোনো এলাকায় কমার্শিয়াল এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস সংযোগ, সিটি করপোরেশন এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ, দুই অথবা তিন চাকা বাদে অন্যান্য মোটরযানের নিবন্ধন বা পুনর্নিবন্ধন, রাজউক, সিডিএ, কেডিএ, আরডিএ অথবা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার নিকট থেকে ভবন নির্মাণ পরিকল্পনা পাস করানো। 

ব্যাংকিং সেবায় যেসব ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে সেগুলো হলোÑব্যাংক অথবা ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট থেকে পাঁচ লাখ টাকার অধিক ঋণের জন্য আবেদন, এলসি খোলা, পাঁচ লাখ টাকার ওপর পোস্টাল সেভিংস অ্যাকাউন্ট থাকলে ১০ লাখ টাকার ওপর ব্যাংকে কোনো ঋণ থাকলে, পাঁচ লাখ টাকার ওপর সঞ্চয়পত্র ক্রয়, ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ।

যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছেÑবিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের সদস্যপদ গ্রহণ অথবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হলে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসমূহ হলোÑকোম্পানির পরিচালক অথবা স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার, ১০ লাখ টাকার অধিক মূল্যের কোনো জমি, দালান অথবা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রেতা, ডাক্তার, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট বা সমজাতীয় পেশা হিসেবে পেশাজীবী সদস্যপদ গ্রহণকারী, যেকোনো ব্যবসা বা পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণকারী, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করানো অভিভাবক, কোনো কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ গ্রহণকারী, বন্দুকের লাইসেন্স গ্রহণকারী, জাতীয় পর্যায়ে যেকোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী, যেকোনো স্থাপনা ও সম্পত্তি ভাড়া প্রদানকারী, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি যারা বেতনপ্রাপ্ত হন এবং সরকারি কর্মকর্তা যাদের মূল বেতন ১৬ হাজার টাকার ওপরে, এমপিওভুক্ত যাদের মাসিক প্রাপ্তি ১৬ হাজার টাকার অধিক, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণে যারা কমিশন গ্রহণকারী, কনসালটেন্সি, ক্যাটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, জনশক্তি সরবরাহ এবং নিরাপত্তা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানির এজেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণকারী, বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত এনজিও যারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রেতা, ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণকারী, পণ্য সরবরাহের জন্য টেন্ডার ডকুমেন্টস জমাকারী, আমদানি ও রপ্তানিতে বিল অব এন্ট্রি জমাকারী।

যেসব ব্যক্তি উপরোক্ত বিষয়সমূহের আবেদন বা মনোনয়ন, বা কোনো লাইসেন্স অনুমোদন, প্রশংসাপত্র, সদস্যপদ, অনুমতি, ভর্তি, সংস্থা বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ, কোনো ঋণ মঞ্জুর করা, কোনো ক্রেডিট জারি করা কার্ড, সংযোগ বা অপারেশন অনুমতি, নির্বাহ করা নিবন্ধন বা কোনো অর্থ প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন, তারা ওই দায়িত্ব পালনের সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র সংগ্রহ করবেন। যদি রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হন, তাহলে সেসব ব্যক্তিকে উপকর কমিশনার অনধিক ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা জারি করতে পারবেন। তবে এই জরিমানা জারির আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যথোপযুক্ত শুনানির সুযোগ দিতে হবে।

ব্যক্তিগত করদাতা নয়, এমন প্রতিষ্ঠান তার নিবন্ধনের বছর এবং পরবর্তী বছরের জন্য রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের পরিবর্তে শুধু টিন সার্টিফিকেট জমা দিয়ে উপরোক্ত ক্ষেত্রে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।

সরকারের হিসাবে টিন গ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সেসব টিন গ্রহণকারীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টিন গ্রহণকারীর রিটার্ন জমা না হওয়ায় তাদের আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব পাওয়া যাচ্ছিল না। বর্তমান আইনের সংশোধনের মাধ্যমে অধিকাংশ টিন গ্রহণকারী রিটার্ন জমা দিতে বাধ্য হবেন। সেক্ষেত্রে সরকার অধিকাংশ টিন গ্রহণকারীর আয়-ব্যয় এবং সম্পদের হিসাবে জানতে পারবেন, যা রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের কাজটা আরও গতিশীল করবে বলে আশা করা যায়। বিপরীত দিকে এই নির্দেশনার ফলে অনেক টিন গ্রহণকারীকে রিটার্ন জমা ও সনদ প্রাপ্তির জন্য আয়কর আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হবে, যা তাদের খরচ বৃদ্ধি করবে। 

আয়কর পরামর্শক