Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 7:24 pm

যেসব খাতে খরচ বাড়তে পারে

রহমত রহমান: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কিছু কিছু খাতে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও কর প্রত্যাহার হচ্ছে। আবার কিছু খাতে বাড়ানো হচ্ছে। যেসব খাতে প্রত্যাহার হচ্ছে বা বাড়ানো হচ্ছেÑসেসব খাতে খরচ বাড়তে পারে। তবে বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য বিলাসী পণ্য, সিগারেট, গাড়ি ইত্যাদির দিকে নজর দিচ্ছে এনবিআর।

এনবিআর সূত্রমতে, সিগারেট খাত থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় করে এনবিআর। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় একাধিক পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেও সে তুলনায় খুব কমই বেড়েছে সিগারেটের দাম। বিশেষ করে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম সে অর্থে বাড়েনি। তুলনামূলক কম আয়ের ধূমপায়ী মানুষ নিম্নস্তরের সিগারেটে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে অন্যান্য পণ্য দামি হলেও সিগারেট তাদের হাতের নাগালে। গত ৫ অর্থবছরে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বেড়েছে মাত্র ১০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি অর্থবছরে বেড়েছে মাত্র দুই টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতি শলাকা সিগারেটের দাম এক টাকা বাড়ালেও গত চার বছরে এর দাম এক টাকাও বাড়েনি। ফলে দাম কম থাকার কারণে নিম্নআয়ের মানুষও এর ব্যয় বহন করতে পারছে। দেশের সিগারেটের বাজারের ৮০ শতাংশ নিম্নস্তরের সিগারেটের দখলে রয়েছে। সম্পূরক শুল্ক কম হওয়ার কারণে নিম্নস্তরের সিগারেট থেকে সরকার বেশি রাজস্ব পাচ্ছে না।

এনবিআর বলছে, দামের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে বাজারের সিগারেটগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলোÑনিম্ন, মাঝারি, উচ্চ ও প্রিমিয়াম। স্তর অনুযায়ী ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৪৫, ৬৭, ১১৩ ও ১৫০ টাকা পর্যন্ত। চারটি স্তরে সম্পূরক শুল্কের হার ৫৮ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। আগামী বাজেটে প্রতিটি স্তরের খুচরা মূল্য ৫ টাকা করে বাড়ানো হতে পারে। সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে। তবে নিম্নস্তরে সবচেয়ে বেশি বাড়তে পারে।

সূত্র আরও জানায়, রাজস্ব আয় বাড়াতে পরোক্ষ কর (আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট) খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পরোক্ষ করের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভাব সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষের ওপর পড়ে। আগামী বাজেটে স্থানীয় শিল্পের কর অবকাশ ও ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা সংকুচিত করে আনা হতে পারে। মোবাইল ফোনে কথা বলা ও মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক রয়েছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের এক শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। আগামী বাজেটে মোবাইল  ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেটে আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে মোবাইল সেবার দাম বাড়তে পারে। এনবিআর বলছে, মানুষ বর্তমানে মোবাইলে কল করার চেয়ে ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করেন। সেজন্য ইন্টারনেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।

সূত্রমতে, বর্তমানে কর অব্যাহতি অথবা হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা পাচ্ছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর, এসি, মোবাইল ফোন ও এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্য। বর্তমানে রেফ্রিজারেটর উৎপাদক পর্যায়ে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ, মূল্য সংযোজনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে তা ২ থেকে সাড়ে সাত এবং বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ। এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ। এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ করা হতে পারে। রেফ্রিজারেটর ও মোবাইল হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে ২ শতাংশের বেশি বাড়ানো হতে পারে। এতে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, ফলের জুস, আমসত্ত্বের দাম বাড়তে পারে। কারণ সরবরাহ পর্যায়ে এসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। এটি বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।

অপরদিকে আইএমএফের পরামর্শে কর ব্যয় কমিয়ে আনতে আমদানি শুল্ক খাতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। শূন্য শুল্কহার বিশিষ্ট প্রায় শতাধিক পণ্যের ওপর এক শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এ তালিকায় রয়েছে চাল, গম, ভুট্টা, সরিষা বীজ, পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল, সানফ্লাওয়ার বীজ, তুলা বীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, ক্রুড অয়েল, সার, প্রাকৃতিক গ্যাস, বিটুমিন, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, ইনসুলিন, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অত্যাবশ্যক ওষুধ এবং ভ্যাকসিন ও ওষুধের কাঁচামাল, বিভিন্ন ধরনের দরকারি রাসায়নিক ইত্যাদি। বর্তমানে ৩৩৫টি আইটেমের পণ্য আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না।

অন্যদিকে, নতুন ভ্যাট আইনে একটি স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট হার (১৫ শতাংশ) ছিল। নানা কারণে সেটি রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে বর্তমানে একাধিক হারে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে এই হার যৌক্তিক করা হবে। এতে করে যেসব পণ্যে ৫, সাড়ে ৭ শতাংশ রয়েছেÑকিছু পণ্যে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। এতে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়তে পারে।

অন্যদিকে, মিথ্যা ঘোষণায় গাড়ি আমদানি ঠেকাতে বাজেটে নির্দেশনা থাকতে পারে। বিশেষ করে হাইব্রিড ও নন-হাইব্রিড গাড়ি বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে। সূত্র বলছে, হাইব্রিড ও নন-হাইব্রিড সংজ্ঞা আরও সুনির্দিষ্ট করা, যে দেশ থেকে আমদানি হবে সেখানকার ঘোষণাপত্র, বিলাসবহুল গাড়ির মূল্য বিবেচনা করা এবং পরিবেশবান্ধব কি না, সে বিষয়ে ছাড়পত্র যাচাই করার বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে। অপরদিকে, কিছু কিছু গাড়ির আমদানি শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।

সূত্রমতে, করদাতা বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থার সঙ্গে এনবিআরের সিস্টেমের আন্তঃসংযোগ নেই। ফলে করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও এসব করদাতাকে করের আওতায় আনতে পারছে না এনবিআর। সরকারি-বেসরকারি ১৬টি সংস্থার সঙ্গে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করবে এনবিআর। সেজন্য এই বিষয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকতে পারে। সংস্থাগুলো হলোÑবিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসি ও ডেসকো, প্রধান আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর (সিসিআইঅ্যান্ডই), আরজেএসসি, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), বিডা, বেপজা, বেজা, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইবাস++, বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক, সিটি কপোরেশন, ভূমি মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি।

এনবিআর বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহকের তথ্য যাচাই করছে। এতে দেখা গেছে, ডিপিডিসির বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ১০ লাখ ২১ হাজার। যার মধ্যে ৬ লাখ ৫৬ হাজার গ্রাহকের টিআইএন নেই, যারা আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। আবার ৩ লাখ ৬৫ হাজার ব্যক্তির টিআইএন থাকলেও বেশিরভাগ নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। আবার ডেসকোর বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ১২ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে বেশিরভাগের ই-টিআইএন নেই, যাদের ই-টিআইএন রয়েছে, তাদের বেশিরভাগ রিটার্ন দেন না।