Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 12:04 pm

যেসব পণ্যের দাম বাড়তে ও কমতে পারে

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করছেন। এই বাজেটে কিছু পণ্যের শুল্ক ও কর কমানো হয়েছে। আবার অনেক পণ্যের শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। বাজেটে যেসব শুল্ককর প্রস্তাব করা হয়, তা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়।

বাড়তে পারে

দেশি ফ্রিজ-এসি: দেশের বাজারে যত ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর বিক্রি হয়, তার ৯০ শতাংশই দেশে উৎপাদিত। দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো যেমন দেশে ফ্রিজ উৎপাদন করছে, তেমনি বিদেশি ব্র্যান্ডের কারখানাও হয়েছে। দেশি তৈরি ফ্রিজে ভ্যাট আড়াই শতাংশ বেড়ে সাড়ে সাত শতাংশ হয়েছে। দেশে ফ্রিজ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) উৎপাদনে ব্যবহƒত বিদেশি কম্প্রেসর ও অন্যান্য উপকরণের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। দেশে তৈরি এসির ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে ফ্রিজ ও এসির মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, কমপ্রেসর দেশেও তৈরি হয়।

সিগারেট: প্রতিবছর বাজেটে সিগারেট, বিড়ি ও তামাকজাতীয় পণ্যের ওপর শুল্ককর বাড়ানো হয়। এবারের বাজেটে সিগারেটের উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্যস্তর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে সিগারেটের দাম বাড়তে পারে। বাড়বে জর্দার দামও।

মোটরসাইকেল: ২৫০ সিসির (ইঞ্জিনক্ষমতা) বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ ধার্য করার সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু পণ্যের বিপরীতে বিদ্যমান আমদানি শুল্ক পাঁচ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দাম বেশি পড়তে পারে উচ্চ সিসির মোটরসাইকেলের।

বিদেশি পানির ফিল্টার: ঢাকা ওয়াসার পানি পানযোগ্য নয়। তা অনেকে ফুটিয়ে পান করেন। অনেকে বাসায় পানি পরিশোধন যন্ত্র বা ফিল্টার বসিয়েছেন। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষার জন্য বিদেশি পানির ফিল্টারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব এসেছে বাজেটে। ফলে দাম বাড়বে।

বৈদ্যুতিক বাতি: বৈদ্যুতিক বাতির মধ্যে এলইডি ও এনার্জি সেভিং বাতির উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতির ভ্যাট। ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। একই হারে বেড়েছে টিউবলাইটের ভ্যাট। এতে বাতির দাম বাড়তে পারে।

বিদেশি মাছ: বিদেশ থেকে ম্যাকারেল নামের একটি সামুদ্রিক মাছ আমদানি হয়। এই মাছ আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। ফলে মাছটির দাম বাড়তে পারে। এই করভার সার্ডিন মাছের সমান করা হয়েছে।

পানীয়: মিষ্টি পানীয়ের দাম বাড়তে পারে বাজেটের পর। কারণ বাজেটে কার্বোনেটেড বেভারেজ বা কোমল পানীয়ের মতো মিষ্টি পানীয় কোম্পানির ওপর লেনদেন কর শূন্য দশমিক ৬ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোমল পানীয়ের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যান্য পানীয়ের ওপর বাড়ানো হয়েছে শুল্ক।

ট্যুর অপারেটর: এ সেবার ওপর বিদ্যমান মূসক অব্যাহতি সেবা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

কাজু বাদাম: কাজু বাদাম আমদানিতে আমদানি শুল্ক ১৫ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। তবে দেশে উৎপাদিত কাজু বাদামেরবাজার বিকাশের উদ্দেশ্যে কাজু বাদাম আমদানিতে ১০ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা হয়েছে।

আমসত্ত্ব, ফলের রস, আইসক্রিম: আমসত্ত্ব ও ফলের রস স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে ভ্যাট পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আইসক্রিমে সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।

ফোনে কথা বলা ও সিম: মোবাইল ফোন সেবায় সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এতে এই সেবায় মোট করভার দাঁড়াবে ৩৯ শতাংশের বেশি, যা কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়াবে। পাশাপাশি ই-সিম তুলতে সম্পূরক শুল্ক ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বাজেটে। ফলে ই-সিম নেয়ার খরচ বাড়বে।

চিকিৎসা ব্যয়: বিশেষায়িত হাসপাতাল বিশেষ শুল্কছাড়ে চিকিৎসাযন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ পেত। হার ছিল এক শতাংশ। বাজেটে ২০০টির বেশি চিকিৎসাযন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। ফলে চিকিৎসাসেবা মূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে হাসপাতালগুলো।

বিনোদন সেবা: বিনোদন কেন্দ্র, তথা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে ভ্যাট দ্বিগুণ (১৫ শতাংশ) করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাড়তে পারে ঘোরাঘুরি ও বিনোদনের খরচ।

ইঞ্জিন অয়েল: বর্তমানে দেশে হাইব্রিড গাড়ি ও আধুনিক প্রযুক্তির মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি পাচ্ছে। এতে সিনথেটিক লুব্রিকেটিং অয়েলের ব্যবহার বাড়ছে। এর আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অনেক বেশি। তবে আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়ন পর্যায়ে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারিত নেই। ন্যূনতম মূল্য টনপ্রতি পাঁচ হাজার ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এর দাম বাড়তে পারে।

ইট: ইটে বিভিন্ন হারে কর বাড়ানো হয়েছে। এতে দাম বাড়তে পারে।

অন্যান্য: শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ককর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। কোনো শিল্পের কাঁচামালই আর শূন্য শুল্কে আমদানি করা যাবে না। এতে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশি সুইচ, সকেট, হোল্ডার ইত্যাদি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমানে দেশে মানসম্মত সুইচ ও সকেট উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু সম্পূর্ণ তৈরি সুইচ-সকেটের ন্যূনতম আমদানি মূল্য প্রকৃত আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে কম। এতে স্থানীয় শিল্প অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সুইচ-সকেটের যন্ত্রাংশ, সম্পূর্ণ সুইচ ও সম্পূর্ণ সকেটের ন্যূনতম মূল্য বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। সুইচ, সকেট ও হোল্ডার প্রভৃতি উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। পাঁচ শতাংশ থেকে করা হয়েছে এক শতাংশ। তবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।

বাজেটের কারণে যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে

ল্যাপটপ: ল্যাপটপ আমদানিতে মূসক প্রত্যাহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। আরও কিছু কর প্রস্তাব আছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন কর পণ্যটিতে মোট করভার ৩১ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে ২০ শতাংশ হবে, যা দাম কমাতে সহায়তা করবে।

গুঁড়োদুধ: বাজারে গুঁড়োদুধের দাম দীর্ঘদিন ধরে চড়া। সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে, এক কেজি গুঁড়োদুধ কিনতে এখন ৭৯০ থেকে ৮০০ টাকা লাগে। বাজেটের পর গুঁড়োদুধের দাম কিছুটা কমতে পারে। কারণ আড়াই কেজি পর্যন্ত প্যাকেটজাত গুঁড়োদুধে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক তুলে নেয়া হয়েছে।

বিদেশি পোশাক: নারী, পুরুষ ও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের পোশাকের সম্পূরক শুল্ক কমানো হয়েছে। ফলে বিদেশি পোশাকের দাম কমতে পারে।

ডায়ালাইসিস সেবা: বাজেটে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবায় ব্যবহƒত ফিল্টারের শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে সেবাটির ব্যয় কমতে পারে। যদিও বিগত বাজেটগুলোয় ডায়ালাইসিস সেবার বিভিন্ন উপকরণে শুল্ককর ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেবামূল্য কমেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।

ডেঙ্গুর কিট: ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের দাম কমতে পারে। কারণ এতে শুল্কছাড় দেয়া হয়েছে।

অন্যান্য: ক্যানসারের ওষুধের কাঁচামাল, শুকনা ফল, মাশরুম, চা, গ্রিন টি, কফি ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুল্ককর ও শুল্কায়ন মূল্যে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে দাম কমার সুযোগ তৈরি হবে।

কম্পিউটার: কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী আমদানির জন্য আমদানিকারক কোনো শর্ত ছাড়াই শুধু পাঁচ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রদান করে সব ধরনের কম্পিউটার ও প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ ইত্যাদি আমদানি করতে পারে, যা প্রকৃত কম্পিউটার সামগ্রী উৎপাদকদের জন্য অসুবিধাজনক। প্রস্তাবিত বাজেটে ওই শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।

নির্মাণসামগ্রী: আবাসনসহ বিভিন্ন নির্মাণ খাতে ব্যবহƒত রড, বার ও এঙ্গেল তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ম্যাংগানিজ ব্যবহƒত হয়। বাজেটে ওই সব পণ্য আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে লোহাজাতীয় পণ্যের দাম কমতে পারে।

ইলেকট্রিক মোটর: ইলেকট্রিক মোটর উৎপাদনে ব্যবহƒত যন্ত্রাংশ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এ কারণে ইলেকট্রিক মোটরের দাম কমতে পারে।

উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণে খরচ: এভিয়েশন খাতের উত্তরণকল্পে ইঞ্জিন-প্রপেলার আমদানি পর্যায়ে মূসক কমতে পারে। এর ফলে উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কমতে পারে।

কার্পেট: কার্পেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল পলিপ্রেপাইলিন ইয়ার্ন আমদানির শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দেশে তৈরি কার্পেটের দাম কমতে পারে।

ক্যানসার চিকিৎসা খরচ: ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহƒত ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধার আওতায় নতুন কিছু কাঁচামাল যোগ হচ্ছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে ক্যানসারের চিকিৎসা খরচ কমে আসবে।

বিদেশি চকোলেট: প্রস্তাবিত বাজেটে চকোলেট আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ কারণে সব বয়সীদের পছন্দের চকোলেটের দাম কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে অন্তত ২৭টি প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানো হচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব পণ্যে উৎসে কর দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হচ্ছে। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছেÑপেঁয়াজ, রসুন, মোটর, ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা এবং সব ধরনের ফলসহ ২৭ পণ্য।