শচীন্দ্রনাথ হালদার: যোগ মানব কল্যাণের একটি সেরা উপকরণ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী যোগের অনুশীলনের দরজা সব মানুষের জন্য উš§ুক্ত। সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম দেহ এবং দীর্ঘজীবন লাভ যোগ অনুশীলনে সম্ভব। যোগের পথ ধরেই বিভিন্ন ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। শক্তি অর্জনে যোগ কাজ করে। জ্ঞান অর্জনে যোগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আধ্যাত্মিক সাধনার পথ যোগ অনুশীলনে প্রশস্ত হয়। যোগ মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যোগীরা যোগ সাধনের মাধ্যমে জগতের সত্যসমূহ দর্শন করেন। যোগ অনুশীলন ছাত্রছাত্রীদের মেধা বিকাশে এবং মনোযোগ বাড়াতে যোগ সমর্থ। চার হাজার বছরের বেশি আগে ঋষি পাতঞ্জলি এ যোগ আবিষ্কার করেন। কিন্তু আধিকারিক যোগীদের কৃপণ মানসিকতার জন্য কালের প্রবাহে যোগ বিনষ্ট হয়। আধুনিককালে স্বামী বিবেকানন্দ যোগকে মানবসমাজে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। যোগের প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগিতা বিবেচনা করে ২১ জুন ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
যোগ বলতে আমরা সাধারণত রাজযোগ বুঝে থাকি। রাজযোগ ধর্মবিজ্ঞান। ধর্মের যাবতীয় প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর প্রদানে রাজযোগ সক্ষম। রাজযোগকে আটভাবে ভাগ করা যায়। যথাÑ১. যম, ২. নিয়ম, ৩. আসন, ৪. প্রাণায়াম, ৫. প্রত্যাহার, ৬. ধ্যান, ৭. ধারণ ও ৮ সমাধি। যম বলতে অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, অচৌর্য, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহকে বুঝায়। এই যম দ্বারা চিত্ত শুদ্ধি হয়। নিয়ম শব্দের অর্থ নিয়মিত অভ্যাস ও ব্রতপালন। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সব ধরনের শৌচই সাধনের জন্য প্রয়োজন। যম ও নিয়ম চরিত্র গঠনের সহায়ক। আসন বলতে বুক, গ্রীবা ও মাথা সমান রেখে দীর্ঘক্ষণ স্বাচ্ছন্দ্যভাবে বসে থাকার অবস্থাকে বুঝায়। আসন দুই প্রকার যথাÑস্বাস্থ্যাসন ও ধ্যানাসন।
প্রাণায়াম শক্তি অর্জনের উপায়। অনেকে মনে করেন প্রাণায়াম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম। আসলে কিন্তু তা নয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাই প্রাণায়াম। প্রাণায়ামের ক্রিয়া তিন প্রকার। যথা রেচক, পূরক ও কুম্ভক। দেহ থেকে শ্বাস বাইরে ছাড়াকে রেচক বলে, শ্বাস বাইরে থেকে দেহের ভেতর প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াকে পূরক বলে এবং শ্বাস দেহের ভেতর বা দেহের বাইরে ধরে রাখাকে কুম্ভক বলে। গৃহীদের বেশি সময় কুম্ভক করা উচিত নয়। প্রাণায়াম ফুসফুসের ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রাণায়ামে মনঃশক্তিরূপ প্রাণের বিকারসমূহকে মানসিক উপায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন প্রাণায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে যোগী অষ্টসিদ্ধ লাভ করতে পারেন। তখন যোগীর নিকট অনন্ত শক্তির দরজা খুলে যায়। অষ্টসিদ্ধ হলোÑঅনিমা, লঘিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রকাম্য, বশিত্ব, ঈশিত্ব ও কামবসায়িতা (সত্য সংকল্পতা)। অষ্টসিদ্ধি লাভ হলে জগতের সমস্ত শক্তিসমূহ ক্রীতদাসের মতো যোগীর আদেশ পালন করে। প্রাণকে যিনি জয় করেছেন সমস্ত জগৎ তিনি জয় করেছেন। তার আদেশে মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার হতে পারে। আমাদের দেহে প্রাণ, অপাণ, সমান, ব্যান ও উদ্যনÑএই পাঁচ ধরনের বায়ু কাজ করে। নাভিমুলে সমান বায়ুর অবস্থান, নাভির ওপরে প্রাণবায়ু এবং নাভির নিচে অপাণ বায়ুর অবস্থান।
মন সর্বদাই কাম, রাগ, লোভ, মোহ, মদ ও পরশ্রীকাতরতা এ ষড়রিপুর তাড়নায় পঞ্চ ইন্দ্রিয় যথাÑচোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বকে সংলগ্ন থাকে। মন সর্বদা বানরের মতো লাফাচ্ছে। এই চঞ্চল মনের বিষয়াভিমুখী গতি ফিরিয়ে অন্তর্মুখী করার প্রক্রিয়াকে প্রত্যাহার করে। দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যাহার প্রক্রিয়া অনুশীলনের মাধ্যমে যোগী নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। চিন্তার একমুখিতাই ধ্যান। ধ্যানাবস্থা মানবজীবনের সর্বোচ্চ অবস্থা। ইতর প্রাণীর সুখ ইন্দ্রিয়ে, মানুষের সুখ বৃদ্ধিতে এবং দেবমানব ধ্যানেই প্রকৃত সুখ লাভ করে থাকেন। মনের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে ধারণ করাকে ধারণা বলে। হƒদপদ্মে, মাথার কেন্দ্রে বা দেহের অন্য কোনো স্থানে মনকে স্থির করার নামই ধারণা।
সাতটি স্তরে যোগী উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। যখন জ্ঞানলাভ হতে থাকে তখন একটির পর আর একটি করে সাতটি স্তরে আসতে থাকে। প্রথম অবস্থায় যোগী বুঝতে পারেন যে তিনি জ্ঞানলাভ করছেন। তখন সমস্ত অসন্তোষের ভাব চলে যায়। দ্বিতীয় অবস্থায় সব দুঃখ চলে যাবে। তৃতীয় অবস্থায় যোগী পূর্ণজ্ঞান লাভ করবেন। চতুর্থ অবস্থায় বিবেক সহায়ে সব কর্তব্যের অবসান হবে। পঞ্চম অবস্থায় চিত্তবিমুক্তি অবস্থা আসবে এবং যোগী বুঝতে পারবেন যে তার বাধবিপত্তি সব চলে গিয়েছে। ষষ্ঠ অবস্থায় চিত্ত বুঝতে পারবে যে ইচ্ছামাত্রই তিনি স্বকারণে লীন হয়ে যাচ্ছেন। সপ্তম অবস্থায় যোগী বুঝতে পারেন যে তিনি স্বরূপে আছেন।
যোগী সাধনার সময় শরীরের মধ্যে নানা প্রকার কাজ চলতে থাকে। এর অধিকাংশই মেরুদণ্ডের মাঝখানে সুষুম্না নাড়িতে হয়ে থাকে। ইড়া (চন্দ্রনাড়ি) মেরুদণ্ডের বামে এবং পিঙ্গলা (সূর্যনাড়ি) মেরুদণ্ডের ডানে অবস্থিত এবং সুষুম্না নাড়ি মেরুদেণ্ডর মাঝখানে অবস্থিত। ইড়া এবং পিঙ্গলা আজ্ঞাবাহী নাড়ি এবং সব মেরুদণ্ড প্রাণীতেই এর কার্যকারিতা রয়েছে এবং মস্তিষ্কের আদেশে দেহের মাধ্যমে কাজ করে। মেরুদণ্ডের মাঝখানে সুষুম্না নাড়ির অবস্থান এবং সব মেরুদণ্ড প্রাণী দেহে এর অস্তিত্ব রয়েছে। সাধারণ মানুষের এ সুষুম্না নাড়ির কোনো কার্যকারিতা নেই এবং এর নিম্নাংশ বন্ধ থাকে। মেরুদণ্ডের নিম্নাংশের সামান্য নিচে কুলকুণ্ডলিনী বা মূলাধারের অবস্থান এবং দেহের শক্তির কেন্দ্র এই মূলাধার। যোগীরা যোগ সাধনার দ্বারা সুষুম্নার নিম্নাংশ খুলে ফেলেন এবং শক্তি ঊর্ধ্বমুখে চালিত করেন। মূলাধার থেকে মাথা পর্যন্ত মেরুদণ্ড সংলগ্ন আটটি চক্র রয়েছে। সর্বনিম্নে মুলাধার চক্র, তারপর স্বাধিষ্ঠান চক্র, মনিপুরচক্র, অনাহত চক্র, বিশুদ্ধ চক্র, আজ্ঞাচক্র, ললনাচক্র এবং মাথার সহস্রদল চক্র। শক্তির দুটি রূপ। একটি পাশবিক রূপ এবং অপরটি আধ্যাতিক রূপ।
যোগ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটায়। যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম দেহ এবং দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারি। এ যুগে মানুষের বয়স ১১৬ বছর। যোগীরা প্রধানত প্রাণের সাধনা করেন। আমাদের খাবার, অসচেতনতা এবং জীবাণু অধিকাংশ রোগের কারণ। প্রাণ মহৌষধি প্রয়োগের মাধ্যমে এসব রোগ থেকে আমরা আরোগ্য লাভ করতে পারি। যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে যে রস নিসৃত হয় তার সমতা বিধান হয়। ফলে আমাদের দেহে আর কোনো রোগ সৃষ্টি হতে পারে না। সমতাই স্বাস্থ্য এবং অসমতাই রোগ। আমাদের দেহের প্যানক্রিয়াস থেকে যে ইনসুলিন নির্গত হয় তা প্রয়োজন মতো নির্গত হলেই আমরা সুস্থ থাকি। যদি প্যানক্রিয়াস থেকে কম ইনসুলিন নির্গত হয় তবে আমরা ডায়াবেটিক (বহুমূত্র) রোগে আক্রান্ত হই। আবার যদি প্যানক্রিয়াস থেকে বেশি পরিমাণ ইনসুলিন নির্গত হয় তাহলে আমাদের দেহে সব সময় ক্ষুধার ভাব দেখা দেয়। আমরা সাধারণভাবে শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবার ৫০০-১০০০ মিলিলিটার অক্সিজেন গ্রহণ করি কিন্তু যোগীরা দীর্ঘ গভীর শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ৫-১০ হাজার মিলিলিটার অক্সিজেন গ্রহণ করেন। ফলে যোগীর দেহের সমস্ত কোষ অক্সিজেনে পূর্ণ থাকে। জীবকোষে অক্সিজেন সরবরাহের অভাবেই আমাদের দেহের অধিকাংশ রোগের কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিজেনের মধ্যে কোনো জীবাণু বা বিজাণু রাখলে মারা যায়। যোগী দীর্ঘদিন যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে মনঃশক্তি চালনার শক্তি অর্জন করেন। দেহে শক্তির ভারসাম্যহীনতাই রোগের কারণ। দেহের কোনো স্থানে শক্তির অভাব দেখা দিলে যোগী মনঃশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সে স্থানের শক্তির অভাবটুকু পূরণ করতে পারেণ। ফলে শিগগিরই তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। অপাণবায়ু দূষিত হলে আমাদের দেহে নানা প্রকার রোগ হয়।
জšে§র মতো মৃত্যুও মানবজীবনের একটি কঠিন সত্য। দীর্ঘ যোগ সাধনের ফলে যোগীর মাথার ব্রহ্মতালুতে দুটি ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে আত্মা যখন দেহ থেকে বের হয় তখন দেহের নয়টি দরজার একটির দরজা দিয়ে বের হয়; যা ভীষণ কষ্টদায়ক। কিন্তু যোগীর আত্মা ব্রহ্মতালু দিয়ে বের হয় বিধায় যোগীর জীবনাবসান সুখকর হয়। যোগী সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় পৃথিবী থেকে অমৃতলোকে গমন করতে পারেন। এটাই যোগের সেরা উপহার।
যোগের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করাই এ যোগ দিবস পালনের উদ্দেশ্য। পৃথিবীর সব মানুষ যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে দিব্য, যোগময় জীবনযাপন করে সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম এবং দীর্ঘজীবন লাভ করুনÑএটাই প্রত্যাশা।
পিআইডি নিবন্ধ