নিজস্ব প্রতিবেদক: সব ক্ষেত্রে যৌক্তিক মূল্যে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় সরকার। এজন্য এখন থেকে নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে দেশে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালাবে সরকার। এ লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো ‘দেশজ প্রাকৃতিক তেল/গ্যাস অনুসন্ধান নীতিমালা, ২০১৯’ করা হয়েছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম স্বাক্ষরিত এ নীতিমালা গতকাল জারি করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কোনো নীতিমালা না থাকায় প্রত্যেক সরকার তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে এ কাজ করেছে। তাই আগের সরকারের নিয়ম বাতিল করেছে পরের সরকার। এখন এ বিষয়টি নিয়মনীতির মধ্যে এলো। নীতিমালা থাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজটি বেগবান হবে।
নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জ্বালানির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়তে সবাইকে যৌক্তিক মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গত এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের ঊর্ধ্বে রাখার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। দেশে ব্যাপক ভিত্তিতে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দেশের উৎপাদিত গ্যাস এ বর্ধিষ্ণু চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
এতে আরও বলা হয়, সম্প্রতি লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানির মাধ্যমে গ্যাসের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমদানি করা এলএনজি অত্যধিক ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশে সরবরাহ করা জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সুপরিকল্পিতভাবে দেশের অনশোর (ভূ-ভাগে) ও অফশোরে (সমুদ্রসীমায়) গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা দরকার।
তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দেশের অনশোর অঞ্চলকে ২২টি ব্লকে এবং অফশোর অঞ্চলকে ২৬টি ব্লকে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক জ্বালানির আমদানি-নির্ভরশীলতা কমাতে প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ জন্য এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলা ও এর আওতাধীন সংশ্লিষ্ট কোম্পানি এবং বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের (জিএসবি) মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধার কাজ সম্পন্ন হবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি অনুসন্ধান/উত্তোলন কোম্পানির গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে পূর্বনির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) বা স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্লোরেশন প্রসিডিউর অনুসরণ করা হবে। এজন্য পরিবেশ, নিরাপত্তা তথা সার্বিক দিক বিবেচনা করে বাপেক্স পূর্ণাঙ্গ ম্যানুয়েল প্রণয়ন করে তা অনুসরণ নিশ্চিত করবে। এছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফএল) তাদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী তেল-গ্যাস উত্তোলনের স্বতন্ত্র এসওপি প্রণয়নের পর তা অনুসরণ করবে।
এদিকে অনশোরের সম্ভাবনাময় যেসব এলাকায় এখনও ভূতাত্ত্বিক ও ভূপদার্থিক জরিপ করা হয়নি, সেসব এলাকায় ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভূতাত্ত্বিক ও ভূপদার্থিক জরিপ সম্পাদন করা হবে। ক্ষেত্রবিশেষে অনুসন্ধান কাজে প্রয়োজন হলে বাপেক্সের সঙ্গে জিএসবিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ভূতাত্ত্বিক জরিপের ভিত্তিতে অনশোরের যেসব সম্ভাবনাময় এলাকায় এখনও টু-ডি সিসমিক সার্ভে সম্পাদন করা হয়নি, সেসব এলাকায় নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে উপযুক্ত টু-ডি সিসমিক সার্ভে সম্পাদন করতে হবে। টু-ডি সিসমিক সার্ভে থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বাপেক্স বিশ্লেষণ করবে। এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার অংশগ্রহণসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ও সহায়তা গ্রহণ এবং আধুনিক কার্যকর প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে।
টু-ডি সিসমিক সার্ভে থেকে পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে চিহ্নিত ও সম্ভাবনাময় প্রসপেক্টাসে কূপ খননের আগে প্রয়োজনে থ্রি-ডি সিসমিক সার্ভে পরিচালনার মাধ্যমে প্রসপেক্টাসের বিস্তৃতি সঠিকভাবে নির্ণয় করে অনুসন্ধান কূপ খননের সঠিক স্থান নির্ধারণ করা হবে। আর অফশোরের যেসব এলাকায় এখনও ব্লক বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, সেসব এলাকায় প্রয়োজনে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে সম্পাদন করা হবে। অফশোরের বরাদ্দকৃত ব্লকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নিয়োজিত ইজারাদারের মাধ্যমে উপযুক্ত ভূতাত্ত্বিক ও ভূপদার্থিক জরিপ সম্পাদন করা হবে।
দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানির আমদানি-নির্ভরতা কমাতে দেশজ তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে অপ্রচলিত রিজার্ভার চিহ্নিতের জন্য উপযুক্ত ভূতাত্ত্বিক ও ভূপদার্থিক জরিপ সম্পাদন করা হবে। এ জন্য উপযুক্ত জনবল গড়ে তোলা হবে। উল্লিখিত পদ্ধতিতে অনশোরে চিহ্নিত সম্ভাবনাময় প্রসপেক্টে অনুসন্ধানযোগ্য কূপের সংখ্যা, স্থান ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে একটি লিড বা প্রসপেক্ট ম্যাপ প্রণয়ন করা হবে। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান কূপ খনন করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অ্যাপ্রাইজাল, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ চিহ্নিতের ক্ষেত্রে এসওপি অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। আর যেসব কূপ ড্রাই, স্থগিত বা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে, তা এসওপি অনুসরণ করে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। অপ্রচলিত রিজার্ভার থেকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি ব্যবহার করে দেশজ তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পাশাপাশি অফশোরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদন কার্যক্রম জোরদার করা হবে বলে উল্লেখ করে নীতিমালায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির (আইওসি) কাছে অফশোরের ব্লক আকর্ষণীয় করার জন্য প্রয়োজনবোধে সময় সময় প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) যুগোপযোগী করা হবে।
অফশোরে উত্তোলিত তেল ও গ্যাস সাব-সি পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ বা অফশোরে স্থাপিত প্ল্যাটফর্মে এলএনজিতে রূপান্তর করে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া অনশোরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যুগোপযোগী পিএসসি, রেভিনিউ শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (আরএসসি), জয়েন্ট ভেঞ্চার, কনসেশন-সহ আধুনিক ব্লক বরাদ্দ ব্যবস্থাপনা পরীক্ষা/নিরীক্ষা করা হবে।
তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদন কার্যক্রম ত্বরান্বিত ও গতিশীল রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ও কারিগরি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পেট্রোবাংলা ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে আধুনিক ও যুগোপযোগী হার্ডওয়্যার/সফটওয়্যারের সুবিধা-সংবলিত স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ ইউনিট গঠন করা হবে। পাশাপাশি দেশের সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা হবে।
তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এ-বিষয়ক উত্তম চর্চা অনুসরণ করা হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে দেশি-বিদেশি সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হবে।
তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদনসহ আহরিত যাবতীয় প্রাথমিক ও প্রক্রিয়াজাত ডেটা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ, ব্যবহার ও শেয়ারিংয়ের লক্ষ্যে পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সহায়তায় একটি কেন্দ্রীয় ডেটা পলিসি প্রণয়ন করা হবে এবং পেট্রোবাংলার কেন্দ্রীয় ডেটা ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিক ও যুগোপযোগী হার্ডওয়্যার/সফটওয়্যার ব্যবহার করে যথাক্রমে বেসিন মডেলিং, জিওলজিক্যাল/স্ট্যাটিক রিজার্ভার মডেলিং, ওয়েল মডেলিং ও ডাইনামিক মডেলিং/সিমুলেশন প্রভৃতি কার্যক্রম সম্পাদন করে পর্যায়ক্রমে পেট্রোলিয়াম সিস্টেম পর্যালোচনা, অনুসন্ধান কূপ খনন, গ্যাসের মজুত নির্ণয়, রিজার্ভার মনিটরিং টুল হিসেবে থ্রি-ডি/ফোর-ডি সিসমিক সার্ভে সম্পাদন, প্রোডাকশন ফোরকাস্টিং/ডিপ্লিশন প্ল্যান প্রভৃতি প্রস্তুত করা হবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল গঠনের জন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।