যৌতুকের নতুন নাম ‘উপহার’

জুবায়ের আহমেদ: নভেল করোনাভাইরাসজনিত রোগে (কভিড) লকডাউনের দিনগুলোয় দেশে বিয়ের হিড়িক পড়েছে। এই বরযাত্রী আপ্যায়নে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি কন্যাপক্ষের অভিভাবকদের। তবে যৌতুকের আদান-প্রদান ছিল আশঙ্কাজনক। আমার পরিচিত এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল না দীর্ঘদিন ধরে, অনেক ছেলে দেখলেও কোনো ছেলেই সে মেয়েকে পছন্দ করছিল না। মেয়ের মায়ের প্রকাশ্য ঘোষণা মেয়ের জামাইকে অনেক কিছু দিয়ে দেবেন তিনি। একমাত্র মেয়ে বলে কথা। তথাপিও মেয়েটির বিয়ে হচ্ছিল না। মেয়ের পরিবার ভালো এবং মেয়েটি শিক্ষিত হলেও বিয়ে না হওয়ার পেছনে কারণ, বলা হতো মেয়ে খাটো ও ততটা রূপবতী নয়। অবশেষে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে, যেখানে উভয় পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে ছেলেকে ২ লাখ টাকা নগদ প্রদান, মেয়েকে ৪ ভরি স্বর্ণালংকার এবং বরযাত্রী আপ্যায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। ছেলে দেখতে খুবই সুদর্শন। মেয়ে পক্ষ খুবই খুশি এমন ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে পেরে। ২ লাখ টাকা প্রদানের বিষয়টি প্রচার করা হয় ছেলেকে চাকরি বা ব্যবসা করার জন্য উপহার দেওয়া হয়েছে মর্মে। তবে আসল বিষয় যে, কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা-মাতা কর্তৃক মেয়েকে যে কোনো মূল্যেই বিয়ে দেওয়া, নগদ টাকা প্রদান ছাড়া বিয়েটি না হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। কেননা ছেলে পক্ষও রাজি হয়েছে মূলত তাদের দাবি পরিশোধ করার কারণেই।

যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮-এ যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের কাছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহের পণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বা বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষেকে প্রদত্ত বা প্রদানের জন্য সম্মত কোনো অর্থ-সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদই যৌতুক, তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হইবে না। বিবাহের সময় দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজন কর্তৃক স্বপ্রণোদিত (দাবিকৃত নয়) হয়ে বর বা কনেকে যে উপহার সামগ্রী প্রদান করেন, তা যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যৌতুক একটি মহামারি ব্যাধি, যে ব্যাধির স্রষ্টা বর পক্ষ, যে ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় কনে পক্ষ। বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হওয়ার আগে একসময় বর পক্ষ যৌতুক হিসেবে নগদ অর্থ, দামি হাত ঘড়ি, রেডিও, টিভি, মোটরসাইকেলসহ আরও কিছু মূল্যবান সামগ্রী দাবি করে নেওয়া হতো, ক্ষেত্রবিশেষ তথা কোনো কোনো পরিবার বেধে এই দাবিতে নমনীয় হওয়ার বিপরীতে দাবি মানতে না পারলে বিবাহ ভেঙে যাওয়া কিংবা বিবাহের পরও দাবি পূরণ করতে না পারলে এসব দাবি (যৌতুক) পূরণ করার জন্য কনের ওপর শারীরিক-মানসিক, অত্যাচার-নির্যাতন, বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা কিংবা পুনরায় বিয়ে করাসহ এহেন কোনো জঘন্য কাজ বাকি ছিল না; যা আমাদের সমাজে বর পক্ষের দ্বারা ঘটেনি, যা এখনও নিয়মিত ঘটছে। ছেলে পক্ষ সম্পদশালী হওয়ার ফলে যেখানে কোনো কিছু দাবি করা থেকে বিরত থাকবে, সেখানে উল্টো অমানবিক সব দাবি তোলা হয় ছেলে পক্ষ থেকে। পাশাপাশি ছেলে বেশি শিক্ষিত হলে, বড় চাকরি, ব্যবসা করলেও ছেলের বাবার দাবির তালিকা বড় হয়ে যায়।

আগে যেখানে নগদ টাকার পাশাপাশি ছোট ছোট প্রয়োজনীয় উপহার সামগ্রী চেয়ে নেওয়া হতো, সেখানে এখন যুক্ত হয়েছে বিশাল টিভি, ফ্রিজ, ফুলসেট ফার্নিচার কিংবা কয়েক পদের ফার্নিচার, স্বর্ণালংকার, ছেলেকে ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া, ব্যবসা করতে সহযোগিতা করা। কোনো কোনো ছেলে পক্ষ এসব সরাসরি দাবি করার বিপরীতে, কেউ কেউ আবার তাদের দৃষ্টিতে ‘আমরা যৌতুক নেবো না’ ভাব দেখিয়ে ছেলেমেয়েকে কী কী দেবে সে ভার মেয়ের পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেন; যা মূলত চেয়ে নেওয়ার মতোই। চেয়ে নেওয়া কিংবা ভার দিয়ে দেওয়া, দুটোতেই মেয়ের পরিবারকে বেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। বরং চেয়ে নেওয়ার চেয়েও ভয়ংকর হলো আপনারা মেয়েকে যা দেবেন, এই রীতিটি। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, মেয়ের পরিবার যা দিয়েছে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি ছেলে বা ছেলের পরিবার, তাই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ছলছাতুরিতে যৌতুক যাওয়া এবং যৌতুকের জন্য শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।

বিয়ের সময় চাওয়া-পাওয়া পূরণের পরও বিবাহের পর মেয়ের পক্ষ কর্তৃক ছেলের পক্ষকে ধর্মীয় উৎসবগুলোতে দামি কাপড় প্রদান করা কিংবা এলাকা ভিন্নতায় গবাদি পশু উপহার হিসেবে দেওয়ার রীতি রয়েছে, সামর্থ্যবানদের কাছে এটা কথিত আন্তরিকতার অংশ হলেও মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্তদের জন্য অমানবিক রীতি। এসব শুধু উপহার হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়, না দিতে পারলে মেয়েকে স্বামীর সংসারে অপমান অপদস্ত হতে হয়, সাংসারিক অশান্তির মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের সমাজে যৌতুকের বিভিন্নরূপ আছে, একেক পরিবার একেক রূপের সম্মুখীন হয়। দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজন যা ইচ্ছাকৃতভাবে দেবে এবং মেয়ের পক্ষ কোনো চাপ ব্যতীত নিজেদের ইচ্ছেমতো যা দেবে, সেগুলোই মূলত উপহার। বিয়ে হওয়ার শর্ত হিসেবে কোনো কিছু চাওয়াই যৌতুক, এই যৌতুক এখন উপহারের মুখোশ পরেছে, যা ধর্মীয় একটি সম্পর্কের মাঝে অন্যায় ও অমানবিক রীতি ও কন্যা দায়গ্রস্ত পিতামাতার জন্য বইতে না পারা বোঝার মতো। কাজেই বিবাহের মতো একটি ধর্মীয় ও সামাজিক পবিত্র বন্ধন গড়ার সময়ে ধর্মীয় রীতি মেনে বিবাহ সম্পন্ন করা এবং উপহারের নামে যৌতুক চেয়ে নেওয়া এবং দেওয়ার জন্য শারীরিক মানসিক নির্যাতন করা বন্ধ করা জরুরি।

শিক্ষার্থী

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম), ঢাকা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০