ইমরান উদ্দিন: যৌতুক দেয়া ও নেয়া দুটোই খারাপ কাজ। আর সেটা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হোক বা বাংলাদেশের সাংবিধানিক নীতিমালা অনুযায়ী হোক। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক উভয় রীতিতে চরম অপরাধ। যৌতুক বর্তমান সমাজে বিষফোঁড়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের একশ্রেণির লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যৌতুকের জন্য কন্যাপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে। ফলে কন্যাপক্ষ যৌতুক দিতে বাধ্য হয়। ইসলাম খুব সুন্দর কনসেপ্টে কম মোহরানা এবং যৌতুকবিহীনকে বিয়েকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু এই সমাজ সেটা বাদ দিয়ে বেশি মোহরানার প্রথা ও যৌতুক প্রথা চালু করেছে।
বর্তমান প্রায় পরিবার যৌতুক নামক কুসংস্কারের শিকার হচ্ছে। এটা পারিবারিকভাবে একটা সিলসিলার মতো হয়ে গেছে। আমাদের সমাজে কয়েক শ্রেণির মানুষ দেখা যায় এই প্রথা নিয়ে। একপ্রকার হলো, সামর্থ্য নেই সামাজিকতা রক্ষার জন্য যারা বাধ্য হয়ে যৌতুক দেয় কোনো উপায় না পেয়ে। এদের আরেক প্রকার হলো, আমার মেয়েকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিয়েছি তাই আমার ছেলের বিয়েতে যৌতুক নেব। এই বিষয়টা খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে সমাজে। আবার এমন কিছু পরিবার সমাজে আছে, যারা সামর্থ্যবান তারা যৌতুক প্রথাকে প্রমোট করার জন্য মেয়েকে সবকিছু দিয়ে বিয়ে দিচ্ছে পাত্রপক্ষের আবদার না থাকা সত্ত্বেও। এই প্রমোটের সংখ্যা কম না। ফলে সমাজ এর প্রভাবটা মারাত্মকভাবে ধারণ করছে। সমাজ গরিবের চেয়ে ধনীর কাজকে বেশি গ্রহণ করছে। অমুক নিছে, আমিও নেব। অমুক দিছে, আমিও দেব। যার বলিদান হচ্ছে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মেয়ে এবং মেয়ের পরিবার। প্রায় সময় নিউজের হেডলাইন হয় তারা। যৌতুক না দেয়ায় তালাক, গৃহবধূকে মারধর অথবা হত্যা ইত্যাদি ইত্যাদি।
যৌতুক এই সংস্কৃতি চালু হওয়ার পেছনে পরিবার ও সমাজ অন্যতম দায়ী। যেমন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সমাজে একটা রসম উল্লেখ করতে পারি, সমাজের কেউ একজন মেয়ে বিয়ে দিলে অথবা ছেলের জন্য পাত্রী ঠিক করলে বিয়ের সময় সমাজের প্রতিটি মানুষকে খাওয়াতে হবে। মেয়ে বিয়ে দিলে নিজের বাড়িতে আর ছেলের জন্য বউ আনলে কনেপক্ষে বাড়িতে খাওয়াতে হবে। না খাওয়াতে পারলে তাকে সমাজে অনেক নিচু মানসিকতার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে খাওয়াতে হয়। শুধু খাওয়াতে হবে তা নয়, মেয়েপক্ষকে বরপক্ষের সমাজের এবং যাবতীয় আত্মীয়-স্বজন সবাইকে খাওয়াতে হবে হরেক রকমের আইটেম দিয়ে। না হলে চায়ের দোকানে বদনামের ঝড় তুলবে। এর জন্য প্রতিটি মেয়ের পরিবারকে ৫০০, ৬০০, ৭০০ বা তার চেয়ে বেশি বরের পক্ষের লোকজনকে খাওয়া হয়। না হলে তার সমপরিমাণ টাকা মেয়েপক্ষ থেকে ছেলেপক্ষকে দিতে হবে। আর এই সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে অনেক মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পরিবার তার নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও অপরের কাছে হাত পাততে যায়। এটা শুধু চট্টগ্রামের চিত্র নয়, সারাদেশে বেশি আর কম চলছে। এ সামাজিক কুসংস্কারের পেছনে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষ জড়িত। আবার কনেপক্ষকে আরও দিতে হবে, মেয়ের রুম সাজানোর যাবতীয় সরঞ্জাম। ফার্নিচার থেকে শুরু করে, যা কিছু দরকার সবকিছু দিতে হবে। না দিলে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বদনাম করবে অথবা খোঁচা দেবে। না হয় মেয়েকে ছোট ভাবা হবে। এই ভয়ে সব মা-বাবা পারুক না পারুক সবকিছু দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। এই বদনাম ও খোঁচা সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। অনেকে মুখ থুবড়ে সহ্য করে যাচ্ছে নিয়মিত। নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয় নিয়মিত। আমাদের খবরের কাগজে হয়তো আসে মাত্র গুটিকয়েক। কিন্তু বর্তমানে প্রায় পরিবারে শারীরিক এবং মানসিক পীড়নের স্বীকার হচ্ছে শুধু যৌতুকের জন্য।
আরেকটা প্রথা চালু আছে, মেয়ের বিয়ের প্রথম বছরে মেয়ের শশুর বাড়িতে প্রতি মৌসুমে যত রকমের ফল বের হয় সব দিতে হবে। একটা-দুটো না অনেক বেশি করে দিতে হবে; যাতে পুরো পাড়ার লোকজন খেতে পারে। রমজানে সবার জন্য পুরো মাসের ইফতারি, ঈদে পরিবারের সবার জন্য কাপড়, কোরবানির সময় গরু অথবা ছাগল দিতে হবে। আরও কত কিছু দিতে হয় এর মধ্যে। আবার যদি সন্তান হয়, তাহলে ছেলে হলে দুটো পশু, মেয়ে হলে একটা পশু দিতে হবে। তার ওপর পুরো পরিবারকে কাপড়-চোপড় দিতে হবে। এই যে কুপ্রথা মানুষ মন-মানসিকতা কতটা নিচু নামলে এমন কিছু করতে পারে? আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, আমার বোনদের আমার মা-বাবা দিয়েছে। এমনও হয়েছে, আপুর বাসায় ভাইয়া এক বস্তা আম নিয়ে গেছে। আপুর শাশুড়ি একটা খেয়ে দেখে টক পেয়েছে বলে সব ফেরত দিছে। আবার দিতে হয়েছে। না দিলে আপুর ওপর চলত টর্চার। কয়দিন আগেই তো পত্রিকায় আসছে, যৌতুক না দেয়ায় গৃহবধূকে নির্যাতন এমনকি মেরেই ফেলছে। এই নিচু মাইন্ডের মানুষকে কখনও আইন দিয়ে সোজা করতে পারবেন? না, কখনও না। যতদিন না তাদের সচেতন করে এই ভিতকে ভেঙে দেয়া না যায়। তাদের সচেতন করার মাধ্যমে এই ভিত ভাঙতে হবে। তবে যৌতুক প্রথা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ধর্মীয় প্রভাবও অন্যতম। কারণ হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল যে, মেয়েরা বিয়ের পর পিতার সম্পত্তির ভাগ থেকে মাহরুম হয়ে যায়। যার জন্য তারা ধনী-গরিব সবাই মেয়ের বিয়ের সময় সবকিছু দিয়ে দেয়। আর এই সংস্কৃতি মডিফাই হতে হতে মুসলমান সমাজেও প্রভাব বিস্তার করে চরমভাবে এবং সেটা অত্যন্ত খারাপভাবে জেঁকে বসেছে।
এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, প্রতিটি পরিবারে, সমাজে, ইউনিয়নে যৌতুক প্রথা বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা। বিভিন্ন এনজিও ও মানবিক ফাউন্ডেশন ও সংগঠনের মাধ্যমে সভা-সেমিনার করা। যাতে মানুষ এই করালগ্রাসি মারাত্মক প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে সজাগ করতে হবে এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। যৌতুক দেয়া এবং নেয়া দুটোই খারাপ কাজ। এটা স্পষ্ট করতে হবে।
এই প্রথা আমাদের সমাজে এখন মারাত্মকভাবে গ্রাস করেছে। আমরা চাইলেও সহজে এই প্রথাকে উঠাই দিতে পারব না। যেখানে যৌতুক প্রথাবিরোধী আইন আছে ও সাংবিধানিকভাবে অপরাধ যোগ্য একটা প্রথা সমাজে হররোজ চলমান হয়ে আছে। সেখানে এই প্রথা বন্ধ করতে পারব না। এই প্রথা বন্ধ করার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ধাপে ধাপে মানুষকে এই প্রথা থেকে দূরে সরাতে হবে। প্রথমত. আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা আগামীতে বিয়ে করবে তাদের সঠিক যৌতুকের কনসেপ্ট দিতে হবে। আমাদের সমাজে যারা অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী আছে, যারা যৌতুকের কনসেপ্ট জানে না তাদের বুঝাতে হবে। আমাদের পরিবারকে এই মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এই প্রথার করাল গ্রাসে কত বোন জীবন দিল। কত স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করল। কত বোন মানসিকভাবে নিয়মিত টর্চারের শিকার হলো। আমাদের বোধ হবে কখন? আমরা কখন পরিবর্তন হবো? সমাজিকভাবে যৌতুককে বয়কট করতে হবে। এরকম ভিক্ষাবৃত্তি মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়