Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:09 am

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি, দিন দিন এটি সমাজে মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে। আধুনিক সমাজে সরাসরি যৌতুক উচ্চারণ না করে গিফট বা উপহার নাম ধারণ করেছে। সমাজের শিরায় শিরায় এটি ছড়িয়ে পড়ছে। এক সময় এটি শুধু সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও এটি বর্তমানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত সব শ্রেণির পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। যৌতুকের জন্য প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে হাজারো নারী কাউকে আবার দিতে হচ্ছে প্রাণ। যৌতুকের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক নারীর সোনার সংসার ভেঙে যাচ্ছে। নির্যাতিত হয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, অনেক নারী সন্তান, সংসার ও পরিবারের মায়া ত্যাগ করে বেছে নিয়েছে আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ। কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা-মাতা তাদের কন্যার বিয়ের বিষয়ে যৌতুক দেয়া নিয়ে চিন্তায় থাকেন। তারা নিজের মেয়েকে সুখী করার জন্য শত কষ্ট সহ্য করে জোগাড় করছেন যৌতুকের টাকা। অনেক পিতা-মাতা যৌতুকের জন্য ঋণ নিয়, নিজের জমিজমা, পৈতৃক সম্পত্তি, নিজের শেষ আশ্রয়স্থলও জলাঞ্জলি দিতে হয়।

সমাজে প্রচলিত হওয়ায় অনেকেই যৌতুককে নিজেদের অধিকার হিসেবে ভাবে এবং নিজেকে অপরাধী মনে করে না। কতশত নারী নীরবে নিভৃতে দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে তার হিসাব নেই। তাই যৌতুকের পরিসংখ্যান হিসাব করা কঠিন। পত্রিকা খুললেই যৌতুকের জন্য নির্যাতন নিয়ে প্রতিবেদন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। শুধু যে অশিক্ষিতদের মধ্যে যৌতুক আদান-প্রদান হয় তা নায়। শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এই জঘন্য কাজ করে আসছেন। কয়েকদিন আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিভাগীয় সভাপতির বিরুদ্ধে তার স্ত্রী অভিযোগ করেন, যৌতুকের টাকার জন্য তার স্বামী প্রত্যেক দিন তাকে নির্যাতন করেন। বাংলাদেশের যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮-এর মতে, বিবাহের সময় বা পরে কোনো পক্ষ যদি বিবাহ টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে কোনো অর্থ-সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পর্ক দাবি করেন সেটি যৌতুক হিসেবে বিবেচিত হবে; তবে মুসলিম আইনের (শরিয়াহ) মহরানা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। কেউ যদি যৌতুক দাবি করেন বা যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের চুক্তি, সহায়তা করেন  তাহলে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং তিনি অনাধিক ৫ বৎসর বা অন্যূন ১ বৎসর বা অনাধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। শুধু আর্থিক লেনদেন নয়  সমাজে বিভিন্নভাবে যৌতুকের লেনদেন হয়ে থাকে। যেমনÑঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, ফ্ল্যাট, মোটরসাইকেল, ব্যবসার খরচ, বিদেশে পাঠানোর  খরচ ইত্যাদি। বিয়েতে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত উপহার হিসেবে দিতে পারবে; তবে সেটি বিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কোনো ব্যক্তি দিতে পারবে। বিয়ের শর্ত হিসেবে যদি কোনো ব্যক্তি ৫০০ টাকা বা তার অধিক টাকা বা সমমূল্যের কোনো উপহার দেন সেটাও যৌতুক হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় উপহার পাঠানো সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যেমনÑসাজন, ঈদে গরু, বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মেয়ের বাসায় উপহার পাঠাতে হয়। উক্ত অঞ্চলের সংস্কৃতি বলে সবাই উপহার পাঠায়। উপহার না পাঠাতে পারলে মেয়েকে তার শশুরবাড়িতে বিভিন্ন কথাবার্তা শুনতে হয়। কিন্তু তা অনেক পরিবারের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক পিতা নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধারদেনা করে হলেও এসব উপহার সামগ্রী পাঠাতে বাধ্য হন। এ সকল সংস্কৃতি সমাজের ক্যানসারের ন্যায় ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ সকল সংস্কৃতি সমাজ থেকে নির্মূল করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

আল্লাহ তায়লা মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহকে হালাল করেছেন। কিন্তু এই হালাল সম্পর্কে তৈরির প্রথম আলোচনাতেই আমরা দেনা-পাওনা নিয়ে দরকষাকষি করি। বিয়ের তারিখ স্থান নির্ধারণের পূর্বেই দেনা-পাওনা হিসাব কষিয়ে নিই। বর-কনে পছন্দ বিষয়টি যেন গৌন, মুখ্য বিষয় হচ্ছে দেনা-পাওনা। দেনা-পাওনা মনমতো হলে বিয়ে হয় না হলে ভেঙে যায়। ইসলাম বিয়েকে হালাল করলেও যৌতুককে হারাম করেছেন। এটি অন্য সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে আমাদের মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের রীতি থেকে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ধর্মে উত্তরাধিকার সূত্রে মেয়েদের বাবার সম্পদের অংশীদারত্বের স্বীকৃতি নেই। সে জন্য বিয়ের সময় মোটামুটিভাবে দেয়া হয় বা নেয়া বিষয়টি সম্পূর্র্ণ করে থাকে। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের প্রভাব মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের ইসলাম ধর্মের নিয়ম এর বিপরীতÑছেলে দেবে, মেয়ে নেবে। ছেলে মহরানা হিসেবে মেয়েকে বিবাহ সম্পূর্ণ করার সময় টাকা দেবে। মুসলিম নিয়ম অনুসারে মেয়ে তার বাবা পৈতৃক সম্পত্তির অংশ পায় কিন্তু হিন্দু ধর্মে সেটির স্বীকৃতি নেই।

যৌতুক দ্বারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যৌতুকের বিরুদ্ধে আইনের সহায়তা নেয়ার পাশাপাশি যৌতুকবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজের মধ্যে যৌতুকের বিভিন্ন কুফল তুলে ধরতে হবে। যৌতুক প্রদান এবং গ্রহণকারী উভয়কে সমাজ চোখে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সামাজিকভাবে শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। মুসলিম সমাজের আলেমদের সরকারি আইনের পাশাপাশি মুসলিম আইন সম্পর্কে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ইসলাম ধর্মে জুলুমের স্থান নেই, সেটি মানুষকে বুঝাতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে যৌতুক ও নারী নির্যাতন আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

রুহুল আমিন শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়