প্রতিনিধি, রংপুর: রংপুর জেলাসহ বিভাগের আট জেলায় কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ইটভাটা। কৃষিজমি, জনবসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে এসব ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। এসব ইটভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন নেই। এ ছাড়া নেই প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রও। এসব ইটভাটা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করে চলেছে। এতে হুমকিতে পড়েছে কৃষিসহ জীববৈচিত্র্য। বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ ও ফসলের মাঠ। পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ-সংশ্লিষ্টরা ও সচেতন মহল। তারা এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তবে জনবল সংকটের কারণে অভিযান চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর কার্যালয়।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, রংপুর জেলাসহ বিভাগের আট জেলায় এক হাজার ৩৭টি ইটভাটার মধ্যে বৈধ রয়েছে মাত্র ১৯৬টি। বাকি ৮৪১টি ইটভাটা সরকারি নিয়মনীতি না মেনে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে রংপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। আর সবচেয়ে কম রয়েছে পঞ্চগড়ে।
পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রংপুরের ২৪৭টি ইটভাটার মধ্যে অবৈধ ২১৫টি, বৈধ মাত্র ৩২টি। লালমনিরহাটে ৫৬টির মধ্যে ২৯টি অবৈধ এবং বৈধ ২৭টি, দিনাজপুরে ২৬৩টির মধ্যে অবৈধ ২০০টি আর বৈধ ৬৩টি, কুড়িগ্রামে ১১২টির মধ্যে ৭৯টি অবৈধ, পঞ্চগড়ের ৫০টি ইটভাটার মধ্যে অবৈধ ৩৯টি, ঠাকুরগাঁওয়ের ৮০টির মধ্যে ৭৩টি অবৈধ। এ জেলায় বৈধ ইটভাটা মাত্র সাতটি।
নীলফামারীর ৫৬টির মধ্যে ৫০টি অবৈধ, বৈধ মাত্র ছয়টি এবং গাইবান্ধার ১৭৩টি ভাটার মধ্যে ১৫৬টিই অবৈধ। এ ছাড়া আইন অমান্য করে এসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। এতে পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, একেকটি ইটভাটা একবার করে পরিদর্শন করলে আবার সেটি পরিদর্শন করা তিন-চার বছরেও সম্ভব হয় না। ফলে অভিযানের পর যেসব ইটভাটা বন্ধ করে দেয়া হয়, তা কিছুদিন পর আবার চালু হয়। শুধু তা-ই নয়, রংপুর বিভাগে অধিদপ্তরে জনবল কম থাকার সুযোগ নিয়ে অসাধু চক্র সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট উৎপাদন ও বিপণন করছে।
জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণ জরিপ, দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণসহ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, প্রয়োজন অনুসারে বিধি লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, মামলা করা, পরিবেশ দূষণকারীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়সহ বিভিন্ন কাজ নিয়মিত পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু জনবল সংকটে অনেক কাজই করতে পারছে না এই পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ রয়েছে, নামমাত্র অভিযান, মামলা ও জরিমানার ধকল পার করে প্রকৃত বিভাগের বেশিরভাগ ভাটা মালিক দিব্যি তাদের ভাটায় ইট উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। এতে যেমন পরিবেশ দূষণসহ কৃষির ক্ষতির অঙ্ক বাড়ছে, তেমনি লাভবান হচ্ছেন মাসোয়ারায় পুষ্ট হওয়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে সচেতন মহল বলছে, কৃষিজমির টপ সয়েলই হচ্ছে ইটভাটাগুলোর মাটির উৎস, যে কারণে একদিকে হাজার হাজার একর জমি পতিত হয়ে কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কমছে কৃষিজমি। কৃষক ও স্থানীয়রা জানান, প্রশাসন সাময়িক জরিমানা করলে বা চিমনি ভেঙে দিলেও কয়েক দিনের মধ্যেই আবারও ইটভাটা প্রস্তুত হয়ে যায়। এসব ইটভাটার ছাইমিশ্রিত ধোঁয়া আম, কাঁঠাল, লিচুর মুকুল ও রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় পরিচালক (উপসচিব) সৈয়দ ফরহাদ হোসেন জানান, বিভাগজুড়ে বিভিন্ন অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি একটি ইটভাটার মালিক ও ম্যানেজারকে কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আগামী দিনে অভিযান আরও জোরদার করা হবে।
অন্যদিকে বিএসটিআই’র রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক (মেট্রোলজি) মফিজ উদ্দিন জানান, গত ৫ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচটি উপজেলার ২৫টি অবৈধ ক্লে ব্রিকস্ (ইট) উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিএসটিআই নিয়মিত মামলা দায়ের করেছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।