রংরাংয়ের চুড়োয় ভবঘুরের দল

২১ মার্চ ২০১৯

রংরাং, আলীকদম, বান্দরবান

সকাল ৭টা ১৫। সূর্য সবে দুই পাহাড়ের মাঝে উঁকি দিয়েছে। দুই ঘণ্টার বেশি সময়ের এক্সট্রিম ট্রেকিং শেষে ভবঘুরের দল অবশেষে রংরাং সামিট করল। রংরাংয়ের চুড়োয় উঠে সবার চোখেমুখে স্বস্তির হাসি; আর সবার শারীরিক ভাষায় পাহাড়জয়ের আনন্দ বিরাজ করছিল। হোক না উচ্চতায় ১৮তম বা ২০তম; একটি প্রায় তিন হাজার ফুট (দুই হাজার ৭৯৫ ফুট) উঁচু চুড়ো থেকে বাংলাদেশের আপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারায় সবাই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছিল। কেননা রংরাং আর ক্রিস্তংয়ে সামিট করার ব্যাপারটাই যে আলাদা। এমন ঘন বন আর পশুপাখিসমৃদ্ধ পাহাড় রংরাং ও ক্রিস্তং ছাড়া দেশে হাতে গোনা কয়েকটি রয়েছে। আমাদের গাইড ল্যাংদা চুড়ো থেকে দেখাতে থাকলেনÑকোন পাহাড় কোন দিকে, কোন পাড়া কোন দিকে, আমরা কোন পথে ফিরব প্রভৃতি। ওপর থেকে প্রায় এক হাজার ফুট নিচের খ্যামচং পাড়াকে যে কী অপরূপ লাগছিল, তা এই খেরো খাতায় লিপিবদ্ধ করা আমার সাধ্যের বাইরে।

এসব এক্সক্লুসিভ পাহাড়ের চুড়োয় উঠলেই দেখা যায়, সামিট পয়েন্টে বোতলভর্তি সামিট নোট; প্রথমে আমরা অতীতে যারা সামিট করেছি, তাদের সামিট নোটগুলো নিয়ে। বেশ কয়েকটি পরিচিত মুখ পেয়ে গেলাম। পেয়ে যাই কিছু লিজেন্ড পর্বতারোহীদের সামিট নোটও। সবাই নোটে তাদের সামিটের তারিখ, সময় ও দলের সদস্যদের নাম লিখে রেখেছেন। অনেকে লিখে গিয়েছেন তাদের দীর্ঘ চলার পথে পাওয়া অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ, আনন্দ, কষ্ট, ভালোলাগা ও ভালোবাসার কথা। এখানেই খুঁজে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পাওয়া সাত বন্ধুর রক্তমাখা সামিট নোট। এ নোটে উঠে এসেছে তাদের দুঃখ, কষ্ট, পথ হারিয়ে ফেলা, দলছুট হয়ে যাওয়া, বন্ধুকে হারিয়ে ফেলা, অ্যাডভেঞ্চারসহ অনেক কিছু। শুধু এ সামিট নোটটা নিয়েই হতে পারে একটি গল্প, একটি উপন্যাস। এ গল্প অন্য আরেক দিন শোনাব। এমন অসংখ্য সামিট নোটে আমরা হারিয়ে যাচ্ছিলাম অসংখ্য পর্বতারোহীর দুঃসাহসিক অভিযানে। আমরা এক এক করে দেখছিলাম আর উপলব্ধি করছিলাম, সামিট নোটগুলোগুলোয় লুকিয়ে রয়েছে কত পর্বতারোহীর ঘাম, রক্ত, তাদের প্রচেষ্টা, ভালোবাসা প্রভৃতি।

আমরা রংরাংয়ের চুড়ো থেকে আশপাশের গ্রাম ও পাহাড়গুলো দেখছিলাম। যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। পাহাড়ের ওপর থেকে ছবির মতো সুন্দর গ্রামগুলো দেখে ভাবছিলাম আমাদের দেশটা এত সুন্দর! আর নিজের মতো করে ক্যামেরাবন্দি করে রাখার চেষ্টা করছিলাম। তবু কিছুতেই যেন মন ভরছে না। মনের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো যে তার চেয়ে অনেক সুন্দর।

এখন আমাদের সামিট নোট লেখার পালা, কিরণ ভাই বসলেন সামিট নোট লিখতে। এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় আমাদের যায় যায় অবস্থা। আমাদের রাঁধুনিরাজ হাসান ভাই রান্নার আয়োজন শুরু করলেন। আজকের মেন্যু স্যুপ উইথ নুডলস্। হাসান ভাই বাঁশ কেটে দ্রুত চুলা বানিয়ে ফেললেন, সঙ্গে পাতিল তো ছিলই। আর ফাঁকিবাজ আমি বসে গেলাম ছবি আঁকতে।

সামিট নোট লেখা শেষে নোটগুলো যত্নসহ ভাঁজ করে বোতলের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখলাম। ভাবতে ভালো লাগছিল এই ভেবে যে, এমন লিজেন্ড পর্বতারোহীদের সামিট নোটের সঙ্গে আমাদের নোটগুলোও স্থান পাবে রংরাংয়ের চুড়োয় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো পর্বতারোহী দল হয়তো আমাদের এ সামিট নোটগুলো বের করে বোঝার চেষ্টা করবেন, এর পেছনে লুকিয়ে থাকা আনন্দ, ভালোবাসা ও শ্রম।

রান্না শেষ করে হাসান ভাই তাড়া দিচ্ছিলেন তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য। আমাদের পেটেও ছুঁচো দৌড়াচ্ছিল। তাই দ্রুত খেতে বসি। হাসান ভাই কলাপাতায় করে পরিবেশন করলেন সুস্বাদু চিকেন কর্ন স্যুপ উইথ নুডল্স। এ ট্যুরের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার তৃপ্তিসহ খেলাম আমরা। খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। যতই বেলা বাড়ছিল, সূর্যের তাপ ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। আমাদের গাইড ল্যাং মুরং তাড়া দিলেন, ‘চলেন তাড়াতাড়ি যাই, নয়তো পথে গরমে কষ্ট পাবেন।’

শাহ জামাল চৌধুরী রেয়ার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০