কাজী সালমা সুলতানা: ১৩ মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। আজকের দিনটিও ছিল মিছিল, মিটিং ও সভা-সমাবেশে উত্তাল। যত দিন গড়াচ্ছিল, স্বাধীনতাকামী বাঙালির ঐক্য ততই সুদৃঢ় হচ্ছিল। অব্যাহতভাবে অসহযোগ আন্দোলনের এক সপ্তাহে পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে দেশ।
এদিন শাপলাকে জাতীয় ফুল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শিল্পী কামরুল হাসানের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে চিত্রশিল্পীদের সভায় এ ঘোষণা দেয়া হয়। অন্যদিকে শিল্পী মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে চারুশিল্প সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্য জহিরউদ্দীন ‘তমঘায়ে হেলাল কায়েদে আজম’ খেতাব বর্জনের ঘোষণা দেন।
১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ সামরিক শাসকের আদেশে ১৫ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। ঘোষণায় বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হবে।
এই নির্দেশ জারির পরই বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচণ্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি, ঠিক তখন নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেয়ার শামিল।’ তিনি বলেন, ‘জনগণকে যত ভয়ই দেখানো হোক
না কেন তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।’
ওয়ালীপন্থি ন্যাপ সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান ও গাউস বক্স বেজেঞ্জো সকালে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধুর চার দফা সমর্থন করে বিমানবন্দরে ন্যাপপ্রধান বলেন, ‘বর্তমান সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি খোলা মনে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একমত।’
এদিন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন।
চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল ফজলের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মহিলা সমাবেশে বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাসদ্রব্য বর্জন ও কালো ব্যাজ ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিকালে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের লালদীঘির জনসভায় নেতারা সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অসহযোগ অবস্থান নিতে আহ্বান জানান। চট্টগ্রামবাসীকে আসন্ন যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানানো হয়।
এদিন জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মানির দূতাবাসের কর্মচারী এবং তাদের পরিবারসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ নাগরিক বিশেষ বিমানে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ত্যাগকারীদের বাড়ি, গাড়ি ও সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর