Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 12:24 am

রক্তে কেনা স্বাধীনতা

কাজী সালমা সুলতানা: ২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দেয়ার ওই হত্যাযজ্ঞের নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এই গণহত্যার মাধ্যমে বিশ্বসভ্যতার এক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা করে পাকিস্তান শাসকেরা।

অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকায় বলা হয়েছে, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী ৯ মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে প্রতিদিন অগণিত নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।

এদিন সকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিস্থিতি সংকটজনক।’

বিকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে, সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দিতে থাকে অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে। এদিকে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনো  রকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। দাবানলের মতো ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায়, ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছেন।’

বাঙালি বুঝে ফেলে, কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান।

এদিন রাত ১০টায় প্রথম ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধসাজে শহরের দিকে রওনা হয়। শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে। মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধোš§ুখ জনতার মাঝ থেকে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান ওঠে।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশলাইনসের চারদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাবডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়।

পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকায় শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পিত হয় পুরো শহর।

সারা ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরিতে। অসংখ্য ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়া হয়। গোটা বাংলাদেশ হয়ে ওঠে শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি।

এই গণহত্যার স্বীকৃতি পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানের সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়।’ তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

পাকিস্তানি হায়নাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। সে রাতে ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনা। হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসনের ২৪নং বাড়িতে। ওই বাড়ির নিচে দু’পায়ে গুলিবিদ্ধ দুই মা তাদের শিশুসন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছিল তাদের রক্তে। পাকিস্তানি হায়েনারা ভেবেছিল, অন্য কোনো দল হয়তো অপারেশন শেষ করে গেছে। তাই তারা আর ওই বাড়িতে ঢোকেনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন প্রাণে বেঁচে যান।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আরও বলেছেন, তাদের বাড়ির নিচে আরেক অবাঙালি অধ্যাপক থাকলেও তিনি ২৫ মার্চের আগে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার সব অবাঙালি পরিবার তা-ই করেছিল। এ থেকেই ধারণা করা যায়, ২৫ মার্চের এ হত্যাযজ্ঞের পূর্বাভাস অবাঙালিরা জানত।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এই পরিকল্পনাটি কার্যকর করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার টিক্কা খান। তারই নির্দেশে ২৫ মার্চের মধ্যরাতের পর পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই রাতে শুধু সাধারণ মানুষের ওপর নয়, প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয় বাঙালি নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরও। ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানায় এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনী যথাক্রমে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ইবিআর) সৈন্যদের গণহারে হত্যা করতে শুরু করে।

প্রথমেই পুরো ঢাকা শহরে হামলা চালানো হয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হত্যা করে জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলসহ বিভিন্ন জায়গায় গণকবর দেয়া হয়। অনেক ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক এএনএম মনীরুজ্জামান, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. ফজলুর রহমান খান, ড. এ মুকতাদির, শরাফাত আলী, এ আ কে খাদেম, অনুদ্ধেপায়ন ভট্টাচার্য, সা’দত আলী, এমএ সাদেকসহ আরও অনেকে।

শুধু ঢাকা শহরে সেদিন কতজনকে হত্যা করা হয়, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে সে সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজারের বেশি হবে। গণহত্যার এই বীভৎস দৃশ্য দেখলে মানসিক ভারসাম্য না থাকার অবস্থা হওয়ার উপক্রম হবে বলে অনেকেই উল্লেখ করেন। গণহত্যার এই রাতে সেনাবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে দৈনিক ইত্তেফাক, পিপলস, গণবাংলা ও সংবাদ-এর কার্যালয়ে।

রাত ১টার পর পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনেকেই আত্মগোপনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু যাননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।’

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সারা দেশে গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে পিপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রেরিত বার্তায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ।