কাজী সালমা সুলতানা: ২৯ মার্চ, ১৯৭১। বহু কষ্টে ঢাকা থেকে গা ঢাকা দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ফরিদপুরে পৌঁছান। জীবন বাঁচাতে দলে দলে মানুষ ভারতে যেতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে গ্রাম পর্যায়েও অভিযান শুরু করে। তবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সিলেটে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় উদ্বেগে পড়ে হানাদার বাহিনী।
চট্টগ্রামে পাক বাহিনীর বহুমাত্রিক হামলায় মুক্তিসেনারা কৌশলগতভাবে দুর্গম অঞ্চলে পিছিয়ে যায়। তবে বরিশালের পেয়ারাবাগান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফরিদপুরসহ সে এলাকার নদীবিধৌত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও যশোর অঞ্চলে গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করে। এদিন পাকসেনারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম বিমান হামলা চালায়। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বোমাবর্ষণ করে। রাজশাহীর চরাঞ্চলে মুক্তিসেনাদের প্রশিক্ষণের খবর আসে বিশ্ব গণমাধ্যমে। শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথে সেনাবাহিনী চেকপোস্ট বসায়। পথচারীদের তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাদের তৎপর দেখা যায়। যশোর শহর থেকে পাকবাহিনী সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়।
ঢাকা-আরিচা সড়কে কল্যাণপুর ব্রিজের কাছে অবাঙালিদের তৎপরতা গত দুদিনে বেড়ে যায়। এ পথে যাতায়াতকারীদের আটক ও তল্লাশি করা হয়। কাউকে সন্দেহ হলে ব্রিজের নিচে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়।
এদিন ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায় বিছিন্নভাবে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবিনিময় হতে থাকে। মধ্যরাতের পরে পাকিস্তান আইনসভায় সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনকারী আইনসভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কুমিল্লার বাসা থেকে পাক বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। তাকে আর তার বড় ছেলে দীলিপ দত্তকে আর কখনও পাওয়া যায়নি।
স্বাধীন বাংলা বেতারে তিন বেলায় তিনটি অধিবেশন প্রচার হয়। এদিকে গ্রেপ্তারের পর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। এদিন সন্ধ্যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অজ্ঞাত স্থান থেকে হেলিকপ্টারে করে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা এয়ারপোর্টে এনে দ্রুত একটি বিশেষ বিমানযোগে করাচির উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিন সারাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথম থেকেই চট্টগ্রামে প্রবলভাবে প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সন্ধ্যার দিকে তারা প্রথম আক্রমণ সূচনা করে। কিন্তু চট্টগ্রামের মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়।
পাবনার মুক্তিযুদ্ধেও অন্যতম নায়ক আমজাদ হোসেন যুদ্ধাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্য পাবনায় প্রবলভাবে প্রতিরোধের মুখে পড়ে। শাহজাদপুরে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা পাবনা থেকে গোপালপুরের পথে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হয় এবং প্রায় সবাই নিহত হয়।
এদিন দিবাগত রাতে প্রায় ১০০ বাঙালি ইপিআর সৈনিককে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে নিয়ে যায় এবং তিনটি গ্রুপে ভাগ করে রমনা কালীবাড়ির কাছে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
সৈনিক সিপাহি লুৎফর রহমান লালমনিরহাট শহরের কাছে অবাঙালি ও বাঙালি ইপিআরদের সংঘর্ষে শহিদ হন। ইপিআর সিপাহি আবদুল হালিম ১২ নম্বর উইংয়ের সুনামগঞ্জ কোম্পানি হেডকোয়ার্টার্সে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে শহিদ হন। এভাবেই সারাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। একই সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১-এর দশ মাস