কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ। রাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী।
এতে ট্রান্সমিশন অ্যান্টেনাসহ ভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরকে বিভিন্ন দিকে থেকে ঘিরে ফেলে এবং বোমাবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আধিপত্য ভাঙতে পাকিস্তানি জান্তা রিজার্ভ সৈন্যদেরও দেশের সব দিকে পাঠাতে শুরু করে।
ভারতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন ইন্দিরা গান্ধী। কয়েক লাখ শরণার্থীর পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার খবর শিরোনাম হয়ে ওঠে বিশ্ব গণমাধ্যমে।
ঢাকার পরে চট্টগ্রাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার দুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা পর্যায়ের প্রতিরোধের খবর আসতে থাকে।
জীবন বাঁচাতে এপারের মানুষের ঢল নামে ওপার বাংলায়। বাঙালি নারী-শিশু-বৃদ্ধদের সীমান্ত পারের এমন মানবিক বিপর্যয় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ও হয়নি বলে নানা সময় গবেষকরা উল্লেখ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে একাত্মতা ও সংহতি ঘোষণা করেন।
এদিন গাংনী উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ জনগণের লড়াই হয়।
সাঁওতাল ও বাঙালিরা সম্মিলিতভাবে নাটোরের লালপুরে ‘ময়নার যুদ্ধে’ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এরই মধ্যে দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ‘যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে’ পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করে বীর বাঙালিরা।
সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্যদানের জন্য বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণের প্রতি আবেদন জানায়।
এদিন রংপুরে পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে শহর-গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালায়, জ্বালিয়ে দেয় বাড়িঘর। রাজশাহীর গোপালপুর লেভেল ক্রসিংয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর লড়াই ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা। লড়াইয়ে বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সম্পূর্ণ সেনাদল ধ্বংস হয়। নোয়াখালীতে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ৪০ পাকিস্তানি সেনাকে বন্দি করে এবং প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্র দখল করে।
মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ২৫৬ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্য নিহত হয়। বিকাল ৫টার দিকে মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনস দখল করেন।
শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন, “আজ সকালে (৩০ মার্চ) এক পাতার মর্নিং নিউজ বেরিয়েছে। উল্টো পাতাটা সাদাই রয়ে গেছে। বিদেশের দু-একটা খবর ছাড়া পূর্ব বাংলার খবর মাত্র দুটিÑ‘মুজিব ওয়ান্টেড সেপারেশন রাইট ফ্রম সিক্সটি সিকস’ (১৯৬৬ সাল থেকেই মুজিব বিচ্ছিন্নতা চেয়ে চেয়ে আসছেন) এবং ‘পাকিস্তান সেইভড, সেইস ভুট্টো’ (ভুট্টো বলেছেন, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে)।”
‘সীমান্তের চারদিক থেকে’ শিরোনামে আনন্দবাজার পত্রিকা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার সশস্ত্র সংগ্রামের বিবরণ ছাপে। পত্রিকাটি এক প্রতিবেদনে জানায়, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ২৯ মার্চ ওপার থেকে এপারে এসেছেন। সবার একটাই লক্ষ্যÑভারত থেকে অস্ত্রসাহায্য সংগ্রহ করা।
এদিকে ফ্রান্সে পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর আট বাঙালি নৌসেনা পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।
তথ্যসূত্র: ৭১-এর দশ মাস, ‘একাত্তরের দিনগুলি’, জাহানারা ইমাম