কাজী সালমা সুলতানা: ৩১ মার্চ, ১৯৭১। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগে নগর-জনপদ ধ্বংস হতে থাকে। সাধারণ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রাণভয়ে এক লাখের বেশি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।
এদিন দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) ও পূর্বদেশ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সরকারের প্রশংসা করা হয়। এতে ফলাও করে লেখা হয় যে, ইস্ট পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার পথে। পূর্বদেশ পত্রিকায় লিখা হয়, ‘শান্তিপ্রিয় বেসামরিক নাগরিকদের যেসব সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী হয়রানি করছিল, তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছে।’ মর্নিং নিউজ শিরোনাম দিয়েছিল, ‘ইয়াহিয়াজ স্ট্যান্ড টু সেভ পাকিস্তান প্রাইজড। পাকিস্তান রক্ষায় ইয়াহিয়ার দৃঢ় সংকল্প প্রশংসিত। ইয়াহিয়া লডেড ফর রাইট স্টেপস টু সেভ কান্ট্রিÑদেশরক্ষায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইয়াহিয়া নন্দিত।’
এদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে এক কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয়। বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে কুষ্টিয়ায় কৃষক-পুলিশ-ইপিআরের সম্মিলিত ৫০০ যোদ্ধার দল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ডেল্টা কোম্পানির সৈন্যদের পাঁচটি অবস্থানে হামলা চালায়। অগ্রসরমান জনতার সমুদ্র থেকে উত্থিত গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ সেøাগান ধ্বনি এবং অব্যাহত গুলিবর্ষণে ডেল্টা কোম্পানির প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।
সকাল ৭টায় হালিশহরের কাঁচা সড়ক জংশনে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড আর্টিলারি, ট্যাংকসহ ইপিআর ব্যূহ ভেদ করে হালিশহরের দিকে অগ্রসর হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ১৫ জনের বেশি ইপিআর সদস্য শহিদ হন।
বেলা ২টায় চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তর, হালিশহরের পতন ঘটে। এদিন চট্টগ্রামের প্রথম গণহত্যা সংঘটিত হয়। চট্টগ্রাম নগরে হালিশহরের মধ্যম নাথপাড়ায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় বিহারিরা এ হত্যাযজ্ঞ চালায়। কুড়াল, কিরিচ আর রামদা দিয়ে কুপিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৪০ জন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর) সদস্য এবং ৩৯ জন নাথপাড়াবাসীসহ ৭৯ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২৫ মার্চ হালিশহর ইপিআর ঘাঁটি থেকে মেজর রফিকের নেতৃত্বাধীন ইপিআর বাহিনী দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দক্ষিণ হালিশহরের বাসিন্দারা নানাভাবে ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। খবর পেয়ে ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গোপসাগর উপকূল হয়ে দক্ষিণ কাট্টলীর ইপিআর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। পরদিন পাকিস্তানি বাহিনী নগরীর উত্তরে গহনা খাল এবং দক্ষিণে ইপিআর ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকা ঘিরে ফেলে। সামান্য অস্ত্র নিয়ে ইপিআরের পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় অধিকাংশ ইপিআর সদস্য এলাকা ত্যাগ করলেও ৪০-৪২ জন মধ্যম নাথপাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
বিহারিরা জল্লাদ শওকতের নেতৃত্বে ৩১ মার্চ দুপুরের দিকে নাথপাড়ায় হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এ সময়ে খুঁজে খুঁজে যুবকদের হত্যা করা হয়। তারপর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। নারী ও শিশুদের আটকে রাখা হয় এক বিহারিরা ঘরে। পরে সেখান থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।
এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি তার নিজের, ভারতীয় জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে একাত্মতা ও সংহতি ঘোষণা করেন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শহিদ জননী জাহানারা ইমামের গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলো ও সংবাদপত্র