রক্তে ভেজা ফেব্রুয়ারি

সামিয়া খানম: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি? হ্যাঁ, এই দুই চরণই যেন ফেব্রুয়ারির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ সবার কানে কানে বলে দেয় তোমরা যে ভাষায় কথা বলো সেটি পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যেটিই কেবল রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। নির্যাতন আর আত্মত্যাগের এই গল্পটা শুরু হয়েছিল দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে। সময়টা ১৯৪৭ সাল, সদ্য বিভাজিত অঞ্চল দুটি ভারত আর পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান ছিল আরও দুই ভাগে বিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। মাঝখানে ১২৪৩ মাইলের ব্যবধান। এই ব্যবধানকে অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর জোর, জুলুম, অত্যাচার চালাত। একপর্যায়ে তারা আঘাত হানে বাঙালির  ভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে ইসলামিকরণ তথা এই ভাষাকে আরবিকরণের লক্ষ্যে প্রথম ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা। এরপর থেকেই চলতে থাকে একের পর এক আন্দোলনের স্রোত। কার্যত বাঙালিরা এই অন্যায্য দাবি মেনে নিতে পারেনি এবং তারা মানসিকভাবেও এটি গ্রহণ করতে মোটেও প্রস্তুত না। একপর্যায়ে আন্দোলন চরমে রূপ নিতে থাকে। আন্দোলনের গতি দেখে পাকিস্তানিরা এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে থাকে। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল মিটিং থেকে সবাইকে দূরে থাকতে বলে। কিন্তু কোনো কিছুই বাঙালিকে তার ভাষার দাবি হতে দূরে সরাতে পারেনি। বাঙালি তার মাতৃভাষা রক্ষায় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল কিছু ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই মিছিল করতে করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে এগোতে থাকে। অতঃপর সেই মিছিলেই চলে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি। রচিত হয় ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার নতুন ইতিহাস। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার আরও নাম না জানা অনেকের প্রাণ ঝরে যায়। এছাড়া মোট ১৭ জন ছাত্র যুবকের মৃত্যু ঘটে। রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার রাজপথ, তবুও থেমে থাকেনি আন্দোলন। অতঃপর ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। আমরা ফিরে পাই আমাদের মায়ের ভাষা। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যে ভাষার মাসে আমাদের এত আত্মত্যাগ সেই ফেব্রুয়ারি আবারও আমাদের মাঝে এসেছে শুধু পার্থক্য হলো রক্তের, দাবি আদায়ের, আর পার্থক্য হলো সময়ের। বায়ান্ন হয়তো আমাদের সময়ের খাতা হতে দূরে চলে গেছে কিন্তু বাঙালির স্মৃতিতে সবসময়ই এটা অনড়। বায়ান্ন এলেই তাই প্রতিটি বাঙালির হƒদয়ে আবারও জেগে ওঠে সেই সুর মোরা দুর্বার, মোরা উত্তাল, মোরা বিধাতার মতো নির্ভীক। অর্থাৎ বাঙালিরা লড়তে জানে, বাঙালিরা পরাজয় করতে নয়; বরং পরাজিত করতে জানে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর পরিবর্তন হলেও স্মৃতিগুলো এখনও আমাদের কষ্টের খাতায় চিরন্তন। তাইতো শামসুর রাহমানের ভাষার বার বার বলতে ইচ্ছা হয়- আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে; কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা; একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা শহিদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ।

শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০