রঙিন মাছে ভাগ্য বদল সালমান সর্দারের

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: পুকুরের পানিতে ভাসছে, ডুব দিচ্ছে লাল, নীল, বেগুনি, কালো, কিংবা বাদামি-রুপালি মাছ। বাফার, রেনবো সার্ক, ডলার, জাপানিজ কই কার্প, লাভ প্যারোট, গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্ভ, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপটি, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল মাছ দেখলে জুড়িয়ে যায় চোখ। ভরে যায় মন। শৌখিন মানুষ সাধারণত তাদের বাসাবাড়ির অ্যাকুয়ারিয়ামে শোভাবর্ধনের জন্য রাখেন এসব রঙিন মাছ। সৌন্দর্যপিপাসুদের ঘরের অ্যাকুরিয়ামে শোভা পাওয়া এ মাছ এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে যশোরে।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার নারাঙ্গালী গ্রামের সালমান সর্দার (৩০)।

ভূগোল ও পরিবেশে এমএসসি করা শিক্ষিত যুবক সালমান শখ পূরণের জন্য ২০১৮ সালের শুরুতে খুলনা শহরের একটি অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশের দোকান থেকে বাড়ির চৌবাচ্চায় পোষার জন্য এক হাজার ৫০০ টাকায় ৬০টি রঙিন মাছ কিনেছিলেন। এরপর শখকেই রূপ দেন বাণিজ্যে। একাগ্রতা আর কঠিন পরিশ্রমে সেখান থেকেই তুলে এনেছেন সফলতা। আবার সেই মাছ দিয়েই রাঙিয়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার শতাধিক বেকারের জীবন। এই যুবকের সেই শখের বাণিজ্যের অর্জন নগদ ও সম্পদ মিলিয়ে কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করেছে। এখন তার নিজের খামারে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের রঙিন মাছ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। বর্তমানে রঙিন মাছের সঙ্গে রঙিন দিন কাটছে সালমান সর্দারের।

সালমান সর্দার জানান, শুরুতে এক হাজার ৫০০ টাকায় কেনা ৬০টি রঙিন মাছের মধ্যে ছিল ১৫টি কই কার্প। ১৫টি বাটার ফ্লাই, ১৫টি কমেট ও ১৫টি গোল্ডফিস। এগুলো তিনি বাড়ির ধান ভেজানোর একটি চৌবাচ্চায় রাখেন। প্রায় ছয় মাস পর পানি পরিবর্তন করতে গিয়ে দেখতে পান কিছু মাছের পেটে ডিম। এরপর ইউটিউব দেখে বাচ্চা ফোটানোর বিষয়ে সামান্য ধারণা পান। কমেট মাছের কিছু বাচ্চা উৎপাদনেও সফল হন। তবে লালনপালনের বিষয়ে ভালো ধারণা না থাকায় তিনি বাচ্চা বাঁচাতে পারেননি। কিছুদিন পর তিনি এসব রঙিন মাছের ভিডিও ফেসবুকে দেন। সেই ভিডিও দেখে কুমিল্লার এক ব্যক্তি তার কাছ থেকে কই কার্প ও কমেট মিলিয়ে ১৮টি মাছ ১১ হাজার টাকায় কিনে নেন। এক হাজার ৫০০ টাকায় কেনা ৬০টি মাছের মধ্যে ১৮টি মাছ এত দামে বিক্রি হওয়ায় তিনি খুবই উৎসাহিত হন। এরপর তিনি আবারও ইউটিউব দেখে রঙিন মাছ উৎপাদন ও পরিচর্যার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে চাষে ঝুঁকে পড়েন।

সে বছরই বাড়ির পতিত পুকুর পরিষ্কার করে মাছ বিক্রির ১১ হাজার এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নেন। সবমিলিয়ে মোট এক লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে চাষ শুরু করেন। তবে রঙিন মাছ পুকুরে চাষ করার প্রথম দিকে গ্রামের অনেকে হাসাহাসি ও উপহাস করেছে। অনেকে বলেছেন, ‘যে মাছ খাওয়া যায় না তার চাষ কইরে কি করবে? সালমান পাগল হইয়ে গেছে।’ চাষ শুরুর ছয় মাস পর ২০১৮ সালের প্রথম দিকে রঙিন মাছের পোনা উৎপাদন ও সেগুলো টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন তিনি। সেসব পোনা ও মাছ বিক্রি করে সে বছরই তিনি সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ করেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সালমানকে।

রঙিন মাছের খামারের আয়ে তিনি দুই বিঘা জমি কিনেছেন, আটটি পুকুর নিয়েছেন, যেগুলোর মোট জলাকার ছয় বিঘা। সেসব পুকুরে রয়েছে, বেশ কয়েক প্রজাতির পর্যাপ্ত পরিমাণ রঙিন মাছ ও পোনা, জমি, পুকুর ও মাছ মিলিয়ে যার বর্তমান বাজারমূল্য কোটি টাকার বেশি। সালমানের কাছ থেকে রঙিন মাছের চাষ শিখেছেন পাবনা সদর উপজেলার মো. সবুজ। তিনি নিজেই এখন পাবনায় বড় বড় দুটি চৌবাচ্চায় রঙিন মাছের পোনা উৎপাদন ও বিক্রি করছেন। তিনি বললেন, ‘সালমান ভাই, আমার মতো আরও অনেককেই বিনা খরচে রঙিন মাছ চাষ সম্পর্কে হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। শেখার পর গত এক বছরে ১০ হাজারের বেশি রঙিন মাছের পোনা উৎপাদন ও বিক্রি করেছি। এতে আমার ভালোই আয় হয়েছে। এখন বুঝে গেছি। বড় আকারে পুকুরে রঙিন মাছ চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রঙিন মাছ বিক্রেতাদের কাছে রঙিন মাছ ও পোনা সরবরাহ করছেন সালমান। এখন বিদেশেও রঙিন মাছ রপ্তানির বিষয়ে প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশের বাজারে রঙিন মাছের চাহিদা রয়েছে। সৌদি আরব ও দুবাইয়ে রঙিন মাছ রপ্তানির বিষয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তবে বিদেশে পাঠাতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের প্রয়োজন। রপ্তানির জন্য সরকারের সহযোগিতা পেলে খুবই ভালো হয়।’

এ ব্যাপারে ঝিকরগাছা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এসএম শাহজাহান বলেন, ‘রঙিন মাছ চাষে সালমান সর্দার সফল। সে ভালো করছে।’ বিদেশে রঙিন মাছ রপ্তানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের রঙিন মাছ নিয়ে তেমন কার্যক্রম নেই। আমরা শুধু খামারের লাইসেন্স দিই। তারপরও বিদেশে রঙিন মাছ রপ্তানির বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা হবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০