রপ্তানিতে জালিয়াতি আর পাচার ‘ম্যাজিক’

রহমত রহমান: পণ্য বন্দর বা অফডকে প্রবেশ করেনি। হয়নি রপ্তানিও। কিন্তু রপ্তানি কাগজপত্র বলছে পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রাও এসেছে। জালিয়াতি করে তৈরি করা সেই কাগজপত্র দিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার প্রণোদনা। রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা বেশি মূল্য দেখিয়ে রপ্তানি করা হয়েছে, যাতে প্রণোদনা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা কম মূল্য ঘোষণা দিয়ে রপ্তানি করা হচ্ছে। এতে একদিকে দেশে রপ্তানির অর্থ পাচার হচ্ছে, অন্যদিকে শুল্ককর ফাঁকি হচ্ছে। আবার পণ্যের ওজন কম বা বেশি দেখিয়ে রপ্তানি হচ্ছে। এতেও অর্থ পাচার হচ্ছে। আবার পণ্যের স্যাম্পল বা নমুনা ঘোষণায় কনটেইনার ভর্তি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। নমুনার আড়ালে কনটেইনার ভর্তি পণ্য রপ্তানির টাকাও পাচার হচ্ছে। রপ্তানিতে প্রতিনিয়ত ম্যাজিক কৌশলে কোটি কোটি টাকা অর্থ পাচার যেমন হচ্ছে, তেমনি সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে রপ্তানিতে জালিয়াতির নানান কৌশল উঠে এসেছে। জালিয়াতি রোধে ছয়টি পদক্ষেপ নিতে সম্প্রতি এনবিআরকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টম হাউস ও স্টেশনে রপ্তানি পণ্য সঠিকভাবে শুল্কায়ন হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পণ্য কায়িক পরীক্ষা হয় না। অ্যাসাইকুডায় পণ্য শুল্কায়ন হয় না। শুধু কর্মকর্তারা রপ্তানির কাগজপত্র দেখে ছেড়ে দেন। ফলে রপ্তানিতে জালিয়াত চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রপ্তানি পণ্য শুল্কায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে।  অথচ জালিয়াতিতে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে অর্থ পাচার ও রাজস্ব ফাঁকি রোধ সম্ভব হবে।

সূত্রমতে, রপ্তানি বাণিজ্যে মিথ্যা ঘোষণা, আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি, অর্থ পাচার ও রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাৎ প্রতিরোধে ছয়টি সুপারিশ দিয়ে এনবিআরকে প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিদেশে অর্থ পাচারের লক্ষ্যে রপ্তানিতে পণ্য মূল্য কম (আন্ডার ইনভয়েসিং) ঘোষণা দেয়া, রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেয়া প্রণোদনা অবৈধ প্রক্রিয়ায় প্রাপ্তির লক্ষ্যে রপ্তানিতে পণ্য মূল্য প্রকৃত মূল্য থেকে বেশি দেখানো বর্তমানে বহুল সংঘতি এবং আলোচিত একটি সমস্যা। অসত্য মূল্য ঘোষণা দিয়ে রপ্তানি বা ঘোষণাতিরিক্ত বা ঘোষণা অপেক্ষা কম পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে সংঘটিত মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাৎ প্রতিহত করা গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে ট্রেড বেইজড মানিলন্ডারিংয়ের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। প্রতিবেদনে রপ্তানিতে কোন কৌশলে অর্থ পাচার হচ্ছে তা তুলে ধরা হয়। কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধানে এসব জালিয়াতি উঠে এসেছে।

ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানিতে জালিয়াতি

প্রতিবেদনে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানিতে কাস্টমস গোয়েন্দার উদ্ঘাটিত কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়। বলা হয়েছে, সরকার কিছু পণ্যের রপ্তানির বিপরীতে ১ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা প্রদান করছে। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্য চালানের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্য ঘোষণা দিয়ে রপ্তানির একাধিক অপচেষ্টা রোধ করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। এর মধ্যে রয়েছে-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সাগর জুট ডাইভারসিফাইড লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি দুইটি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির চেষ্টা করেছে। ১৮ হাজার পিস ডোর ম্যাটের প্রতিটির রপ্তানি মূল্য ঘোষণা করেছে ৫ দশমিক ২৫ ডলার। কিন্তু কায়িক পরীক্ষা ডোর ম্যাটের স্থলে ৬ হাজার ১১৬ পিস জুট ন্যাপকিন পাওয়া যায়, যার প্রতিটির রপ্তানি মূল্য মাত্র ২০ সেন্ট। একই প্রতিষ্ঠান প্রতি পিস ৮ ডলার ৩০ সেন্ট মূল্য ঘোষণা করেছে ১২ হাজার পিস টেবিল রানার। কায়িক পরীক্ষায় মাত্র ২০ সেন্ট মূল্যের ৬ হাজার ১১৬ পিস জুট ন্যাপকিন পাওয়া যায়। দুটি চালানে প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত রপ্তানি ঘোষণা দিয়ে ১৬ লাখ টাকা করে রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাতের চেষ্টা করেছে।

আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি

প্রতিবেদনে বলা হয়, রপ্তানি পণ্য চালানে প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা কম ঘোষণা, প্রকৃত রপ্তানি মূল্য গোপন করে রপ্তানি চেষ্টার একাধিক ঘটনা কাস্টমস গোয়েন্দা উদ্ঘাটন করেছে। ঢাকার জি ফ্যাশন ট্রেডিং এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট নামক প্রতিষ্ঠানটির টি-শার্টের আটটি চালান আটক করা হয়। সাধারণত টি-শার্টের ওজন প্রতিটি  ১৮০-২০০ গ্রাম হয়। কখনো ৩০০-৪০০ গ্রাম হয় না। কিন্তু এই চালানে প্রতি পিস টি-শার্টের ওজন এক কেজি ৩৪০ গ্রাম থেকে ৪ কেজি ১০০ গ্রাম পর্যন্ত ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রতি পিস টি-শার্টের রপ্তানি মূল্য ২-৩ ডলার হয়ে থাকে। কিন্তু রপ্তানিকারক প্রতি পিস ১১ থেকে ২৬ সেন্ট দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত রপ্তানি মূল্যের চেয়ে ঘোষিত মূল্য অনেক কম।

কম পরিমাণ পণ্য ঘোষণায় অধিক পরিমাণ পণ্য রপ্তানি, অধিক পরিমাণ ঘোষণায় কম পণ্য রপ্তানি

প্রতিবেদনে বলা হয়, রপ্তানি চালানে প্রকৃত পরিমাণ অপেক্ষা কম পরিমাণ ঘোষণা দিয়ে রপ্তানির একাধিক চালানের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন গার্ডেন নিটওয়্যার ৯৩ হাজার পিস পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দেয়। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় এক লাখ ২৪ হাজার ৯৮৭ পিস পোশাক পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি ইনভয়েসে কম পরিমাণ ঘোষণা দিয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য রপ্তানির চেষ্টা করেছে। একাধিক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির চেষ্টা প্রতিহত করা হয়েছে।

রপ্তানি দলিল জালিয়াতি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি অর্থাৎ অন্য প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করে আসছে। আবার বিল অব এক্সপোর্টে স্যাম্পল বা নমুনা রপ্তানির কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় দেখা গেছে, স্যাম্পল নয়, কয়েকশ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে। আর কয়েকশ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানির চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন-সাবিহা সাইকি ফ্যাশন বিভিন্ন সময় স্যাম্পল ঘোষণায় মোট ৮৬টি চালানের মাধ্যমে ৯৯৭ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করেছে। এ পণ্যের রপ্তানি মূল্য ২১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটি পাচার করেছে। একইভাবে এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন, ইমো ট্রেডিং করপোরেশনসহ বহু প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে।

ভুয়া রপ্তানি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। কিন্তু কিছু আমদানিকারক জাল বা ভুয়া রপ্তানির কাগজপত্র তৈরি করেছে। যা দেখিয়ে প্রণোদনা আত্মসাৎ করেছে। কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আহনাফ করপোরেশন ১১১টি ভুয়া বিল অব এক্সপোর্টে প্রায় ৩১ কোটি ৮১ লাখ টাকার রপ্তানি দেখিয়ে প্রায় ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা প্রণোদনা নিয়েছে। জান্নাত করপোরেশন ১৭৫টি বিল অব এক্সপোর্টে প্রায় ৩০ কোটি ৭২ লাখ টাকার বিপরীতে প্রায় ৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা প্রণোদনা নিয়েছে। ফাতেমা করপোরেশন ৬৮টি বিল অব এক্সপোর্টে প্রায় ২৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বিপরীতে প্রায় ৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রণোদনা নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির পণ্য কখনও অফডক বা বন্দরে প্রবেশ করেনি। এমনকি কোনো পণ্য রপ্তানিও হয়নি। কিন্তু রপ্তানির ভুয়া কাগজপত্র (বিল অব এক্সপোর্ট, এলসি, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট) তৈরি করেছে। যার বিপরীতে বিদেশ থেকে রপ্তানির টাকা এসেছে দাবি করে প্রণোদনা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। এমন বহু প্রতিষ্ঠান ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রণোদনা আত্মসাৎ করেছে বলে কাস্টমস গোয়েন্দা প্রমাণ পেয়েছে।

বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম

প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্ডেড প্রতিষ্ঠান বেশি অনিয়ম করছে। কম পণ্য ঘোষণা দিয়ে বেশি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছে। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার স্থানীয় বাজার থেকে নি¤œমানের পণ্য কিনে বিদেশে রপ্তানি করছে। বন্ড সুবিধার কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শুল্ককর ফাঁকি দিচ্ছে। আবার কিছু বন্ড প্রতিষ্ঠান ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচার করছে, অবৈধ রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাৎ, মূসক ও আয়কর ফাঁকি দিয়ে আসছে। কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সোয়ান নিট কম্পোজিট লিমিটেড ১২ হাজার কেজি লেডিস ড্রেস রপ্তানির ঘোষণা দিলেও কায়িক পরীক্ষায় ২০ হাজার ৪৬০ কেজি পোলো ব্রান্ডের টি-শার্ট পাওয়া গেছে। একই প্রতিষ্ঠান অপর একটি চালানে ১২ হাজার কেজি লেডিস ড্রেস রপ্তানির ঘোষণা দিলেও কায়িক পরীক্ষায় ২৩ হাজার ১৬ কেজি টি-শার্ট পাওয়া যায়। এছাড়া আরও বহু বন্ডেড প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য রপ্তানি করার মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে।

সূত্রমতে, রপ্তানিতে জালিয়াতি ও অর্থ পাচার রোধে ছয়টি পদক্ষেপ নিতে প্রতিবেদনে এনবিআরকে সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হলো, ঝুঁকিপূর্ণ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে  সেগুলোর রপ্তানি পণ্যের মূল্য ও পরিমাণের সঠিকতা নিশ্চিত করে রপ্তানির অনুমোদন দেয়া। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কাস্টম হাউস ও স্টেশনকে নির্দেশনা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, এনবিআর, অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও কাস্টম কর্মকর্তাদের আলোচনার মাধ্যমে অনিয়ম প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করা। তৃতীয়ত, রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে ব্যবহƒত উপকরণের মূল্য, মজুরি, কারখানার ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা। চতুর্থত, যেকোনো পণ্যের রপ্তানি পারমিট ইস্যুর আগে পণ্যের বিবরণ ও পরিমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত মূল্য প্রদর্শন করেছে কি না তা ব্যাংক কর্মকর্তা রপ্তানি পারমিট ইস্যুকারী কর্মকর্তার যাচাই করা। পঞ্চমত, অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। ষষ্ঠত, অনিয়ম করা রপ্তানি পণ্য চালানের পরীক্ষণ ও শুল্কায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০