রহমত রহমান: এক বছরে ১৬৮ বিল অব এন্ট্রিতে বন্ড সুবিধায় প্রায় ৩১ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৪৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান বলছে কাঁচামাল দিয়ে মসৃণ টাইলস তৈরি করে রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানির সপক্ষে বিল অব লেডিং, বিএলসহ রপ্তানির সব কাগজপত্র দেয়া হয়েছে, যাতে শিপিং এজেন্টের নাম, ডিপোর নাম ও পণ্য পরীক্ষণকারী কর্মকর্তার নাম রয়েছে। কিন্তু তদন্তে জানা গেল, যে দুই শিপিং এজেন্ট ও যে দুই ডিপোর নাম ব্যবহার করা হয়েছে, তারা রপ্তানির বিষয় জানেই না। পরীক্ষণকারী দুই কর্মকর্তার সই জাল করা হয়েছে। এত সব জালিয়াতির উদ্দেশ্য হলো, প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার সব কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। জালিয়াতি ও অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় ১৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান টাকা পরিশোধ না করে আপিলাত ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট সব জায়গায় গেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা পাঁচ বছর পরও হলেও প্রতিষ্ঠানকে ফাঁকি দেয়া শুল্ককর ও অর্থদণ্ডসহ মোট ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। জালিয়াতি করা প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। অর্থদণ্ডসহ ফাঁকি দেয়া শুল্ককর পরিশোধে সম্প্রতি কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) থেকে প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বন্ড কমিশনারেট থেকে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে ফাঁকি দেয়া ৫৫ কোটি আট লাখ ৭৮ হাজার ৪০৮ টাকা রাজস্ব পরিশোধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি বন্ড কমিশনার বিচারাদেশ দেয়, যাতে প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ৪০ কোটি আট লাখ ৭৮ হাজার ৪০৮ টাকা ও অর্থদণ্ড ১৫ কোটি টাকাসহ মোট ৫৫ কোটি আট লাখ ৭৮ হাজার ৪০৮ টাকা আদায়ে আদেশ দেয়। একই বছর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করা হয়। ট্রাইব্যুনাল বন্ড কমিশনারের আদেশ বহাল রাখেন। আপিলাত ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হাইকোটে রিট করা হয়। হাইকোর্ট থেকে মামলাটি ‘নন-প্রসিকিউশন’-এর জন্য ‘ডিসচার্জ’ করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ফাঁকি দেয়া ৫৫ কোটি আট লাখ ৭৮ হাজার ৪০৮ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
অন্যদিকে এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে বন্ড কমিশনারেটের নেয়া পদক্ষেপ বিষয়ে এনবিআরকে অবহিত করে চিঠি দেয়া হয়। কমিশনার মোহাম্মদ আহসানুল হকের সই করা চিঠিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের ২০১৬ সালের ২৩ মে থেকে ২০১৭ সালের ২২ মে পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত নিরীক্ষা সম্পাদনের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০১৮ সালের ২৭ মার্চ প্রতিবেদন দেয়। প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করেনি। ফলে আমদানি করা কাঁচামালের উপর প্রযোজ্য শুল্ককর ৩৮ কোটি ৮৬ লাখ ৪৮ হাজার ১০০ টাকা আদায় ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে কমিটি। কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২২ মে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। একইভাবে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের জন্য এক কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ৩০৭ টাকা আদায়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি পৃথক দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। আবার দুদক থেকে তথ্য চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানের সব তথ্য দেয়া হয়।
আরও বলা হয়, ১৯ নভেম্বর প্রতিষ্ঠান জবাব দেয়। শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি কমিশনার বিচারাদেশ দেয়, যাতে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়। প্রযোজ্য মোট শুল্ককর ৪০ কোটি আট লাখ ৭৮ হাজার ৪০৮ টাকা ও অর্থদণ্ড ১৫ কোটি টাকাসহ মোট ৫৫ কোটি আট লাখ ৭৮ হাজার ৪০৮ টাকা সরকারি কোষাগারে জমাদানের নির্দেশ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠান আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করে। ট্রাইব্যুনাল কমিশনারের রায় বহাল রাখে। প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের ১৮ জুন হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। আদালত ১৫ দিনের স্থগিতাদেশ দেন। কিন্তু বিষয়টি দীর্ঘদিন পড়ে ছিল। অর্থাৎ প্রায় চার বছর পর জানা গেল মাত্র ১৫ দিনের স্থগিতাদেশ দিয়েছে। সম্প্রতি রুল নিশি জারির কপি তোলা হলে তাতে ১৫ দিনের স্থগিতাদেশের বিষয়টি সামনে আসে। পরে রিট দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি দেয়া হয়। হাইকোর্ট সম্প্রতি ‘নন-প্রসিকিউশন’-এর জন্য মামলাটি ‘ডিসচার্জ’ করে দেন।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের ২৭ মার্চ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী মসৃণ টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালে বন্ড লাইসেন্স দেয়া হয়। সিআইএস সেল, লিয়েন ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত আমদানি-রপ্তানির ডেটা পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়া রপ্তানির সপক্ষে প্রতিষ্ঠানের দেয়া বিল অব লেডিংসহ সংশ্লিষ্ট শিপিং কোম্পানির কাগজপত্র যাচাই করা হয়। এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ২২ মে পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে মোট ১৬৮টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে টাইলস ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করে, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৩১ কোটি ৫২ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৭ টাকা। এতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৪৪ কোটি ১৫ লাখ ৩২ হাজার ১৭২ টাকা। প্রতিষ্ঠান দাবি করে ৮০টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে আট লাখ ৭৮ হাজার ৬০৭ স্কয়ার মিটার টাইলস রপ্তানি করেছে। এর সপক্ষে প্রতিষ্ঠান বিল অব লিপিংসহ রপ্তানির সংশ্লিষ্ট কাগজ দেয়।
প্রতিষ্ঠান দাবি করে, শিপিং এজেন্ট ওয়ান কার্গো লিমিটেড ও জেডঅ্যান্ডজেড এক্সপ্রেস লিমিটেডের রপ্তানি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি এই দুটি শিপিং এজেন্টকে চিঠি দেয়। শিপিং এজেন্ট দুটি জানায়, তাদের মাধ্যমে রপ্তানি হয়নি। প্রতিষ্ঠানের লিয়েন ব্যাংকে দাখিল করা বিএলসমূহ সঠিক নয়, জাল। তাদের মাধ্যমে কোনো পণ্য শিপমেন্ট হয়নি। প্রতিষ্ঠান মেসার্স গোল্ডেন কনটেইনারস লিমিটেড ও মেসার্স ইনকনট্রেড লিমিটেডÑএ দুটি ডিপোর মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি হয়েছে বলে কাগজপত্রে উল্লেখ করে। কমিটি এই দুটি ডিপোকে চিঠি দিলে তারা জানায়, দুই ডিপোর মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি হয়নি। কাস্টম হাউসের যে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তা চালানগুলো পরীক্ষণ করেছেন, তাদের চিঠি দেয় কমিটি। তারা জানান, এই চালানগুলো তারা পরীক্ষণ করেননি। তাদের সই জাল করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান কোনো পণ্য রপ্তানি করেনি, মূলত রপ্তানির জাল কাগজপত্র তৈরি করেছে। অবৈধভাবে অপসারণ করে সব কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানকে এর আগে পাঁচটি দাবিনামা জারি করা হয়েছে, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর পাঁচ কোটি ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৭২ টাকা। মোট শুল্ককর ৪৪ কোটি ১৫ লাখ ৩২ হাজার ১৭২ টাকা থেকে দাবিনামা জারি করা শুল্ককর বাদ দেয়া হয়, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর হয় ৩৮ কোটি ৮৬ লাখ ৪৮ হাজার ১০০ টাকা। এই শুল্ককর আদায় ও অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ করায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে কমিটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২২ মে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে বন্ড কমিশনারেট। প্রতিষ্ঠান লিখিত জবাবে দাবি করে, তাদের কাছে পিআরসি রয়েছে। কিন্তু বিল অব লিডিংসহ রপ্তানির সব কাগজপত্র যাচাই করে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি বলে পাওয়া যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি বিচারাদেশ দেয় বন্ড কমিশনার, যাতে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় ১৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান খাজা। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত বুধবার তার মোবাইল ফোন নম্বরে ফোন করা হয়। তিনি রিসিভ করে কী বিষয় জানতে চান। বক্তব্যের বিষয় বলা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন।