রহমত রহমান: বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। সেই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানিও হয়েছে। কিন্তু রপ্তানির টাকা বাংলাদেশে আসেনি। দুই রপ্তানি চালানে দেশে আসেনি প্রায় ১৫১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ও প্রায় ১১৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। দেশে টাকা না আসায় শুল্ককর পায়নি সরকার। আবার বন্ডিং মেয়াদ শেষ হওয়া কাঁচামাল ও বন্ড সুবিধায় আমদানি করা অ্যাককেসরিজের হদিস নেই। এই কাঁচামাল ও অ্যাকসেসরিজ থেকে সরকার শুল্ককর পায়নি। রপ্তানির টাকা দেশে আসেনি, কাঁচামালের হদিস না থাকা এই প্রতিষ্ঠান হলো নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান কুনতাং অ্যাপারেলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান তিন বছর ধরে বন্ধ। মালিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
এনবিআর কর্মকর্তাদের ধারণা, মালিক রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার করেছেন। শুল্ককর পরিশোধ না করেই মালিক দেশ ছেড়েছেন। প্রযোজ্য শুল্ককর আদায়ে প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)। একই সঙ্গে রপ্তানির টাকা অবৈধভাবে পাচারের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়েছে। বন্ড কমিশনারেট বলছে, কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব না দেয়া হলে একতরফা বিচারাদেশ করা হবে। বিচারাদেশে প্রযোজ্য শুল্ককর ও জরিমানা আদায়ে ইপিজেডকে চিঠি দেয়া হবে। ইপিজেড প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি, মেশিনারিজ, প্লট নিলামে বিক্রি করে শুল্ককর ও জরিমানা পরিশোধ করবে।
ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্রমতে, কুনতাং অ্যাপারেলস লিমিটেড আদমজী ইপিজেডের একটি শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি টি-শার্ট, জ্যাকেট ও নিট আইটেমের পণ্য তৈরি করত। ২০০৬ সালে বন্ড লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রপ্তানির অর্থ দেশে আনার বিষয়ে অভিযোগ পায় বন্ড কমিশনারেট। পরে বন্ড কমিশনারেটে থাকা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই করা হয়; যাতে আমদানি-রপ্তানির সঠিক তথ্য পাননি কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাশ বোর্ড হতে তথ্য যাচাইয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের একটি ইএক্সপির বিপরীতে রপ্তানির এক কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ৭২৪ ডলার ওভারডিউ (মেয়াদোত্তীর্ণ আয় বা রপ্তানির অর্থ যে সময়ের মধ্যে দেশে আসার কথা, সে সময়ে আসেনি) রয়েছে; যা বাংলাদেশি টাকায় ১৫১ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ২৮৭ টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের আরেকটি ইএক্সপির বিপরীতে রপ্তানির এক কোটি ৩৮ লাখ ৪ হাজার ৪৯৩ ডলার ওভারডিউ রয়েছে; যা বাংলাদেশি টাকায় ১১৭ কোটি ৪৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫০ টাকা। প্রতিষ্ঠান রপ্তানির আড়ালে এই অর্থ পাচার করেছে বলে ধারণা করছেন বন্ড কর্মকর্তারা। কাস্টমস আইন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, অর্থ অবৈধভাবে পাচারের দায়ে কেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হবে নাÑ তা জানাতে প্রতিষ্ঠান পৃথক কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে বন্ড কমিশনারেট।
অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানের ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আমদানি, রপ্তানি দলিলাদি নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা ৪ লাখ ৯ হাজার ৭৪৯ কেজি ফেব্রিকসের বন্ডিং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে; যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ২০ কোটি ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৩২ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ১৭ কোটি ৯১ লাখ ৭ হাজার ২৬১ টাকা। এছাড়া ৮১ হাজার ৮৬০ কেজি অ্যাকসেসরিজের (লেবেল, ইন্টারলাইটিং, বাটন, জিপার, সুইং থ্রেড) শুল্কায়নযোগ্য মূল্য এক কোটি ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ২১৪ টাকা; যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৫১ লাখ ১১ হাজার ৭৭৬ টাকা। বন্ডিং মেয়াদোত্তীর্ণ ও অন্য কাঁচামাল প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠান অপসারণ করায় শুল্ককর পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামাসংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান এসব কাঁচামাল বিক্রি করে দিয়েছে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠান আমদানি-রপ্তানি করলে তার ডকুমেন্ট প্রতিষ্ঠান দিলে আমরা অডিট করি। সেক্ষেত্রে কী পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি হয়েছে, টাকা দেশে এসেছে কি নাÑ তা জানা যায়। তবে প্রতিষ্ঠান আমদানি-রপ্তানির হিসাব না দিলে আমরা সিস্টেম থেকে অডিট করি। সেখানে আমরা আমদানি করা কাঁচামাল ও রপ্তানি করা পণ্যের হিসাব করি। রপ্তানির টাকা যদি দেশে আসে, আর প্রতিষ্ঠান যদি সপক্ষে কোনো ডকুমেন্ট দিতে পারে, তাহলে হিসাব হয় একরকম। আর যদি প্রতিষ্ঠান কোনো ডকুমেন্ট না দিতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটাবেজ থেকে টাকা দেশে আসার কোনো তথ্য না পাই, সেক্ষেত্রে আমরা ধরে নিই অর্থ পাচার হয়েছে। কুনতাং অ্যাপারেলস লিমিটেড থেকে আমরা রপ্তানির অর্থ দেশে আসার কোনো ডকুমেন্ট পাইনি। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচার হয়েছে। শুধু কুনতাং নয়, ইপিজেডের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তিন বছর ধরে প্রতিষ্ঠান বন্ধ, সেক্ষেত্রে শুল্ককর আদায়ের প্রক্রিয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ, ফ্যাক্টরি ও প্লট রয়েছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কোনো ডকুমেন্ট না দিতে পারলে একতরফা বিচারাদেশ হবে। আইন অনুযায়ী, বিচারাদেশে দেয়া জরিমানা ও প্রযোজ্য শুল্ককর আদায়ে আমরা ইপিজেড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবো। ইপিজেড বন্ধ এই প্রতিষ্ঠান, মেশিনারিজ ও প্লট নিলামে বিক্রি করবে। বিক্রির টাকা থেকে জরিমানা ও শুল্ককর পরিশোধ করবে ইপিজেড।
কুনতাং অ্যাপারেলস লিমিটেডের সাবেক একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে তিন বছর আগে মালিক সানজি মাদানি হংকং চলে গেছেন। পণ্য রপ্তানি হয়েছে জানি। কিন্তু টাকা দেশে এসেছে কি না, আমার জানা নেই। তবে কী কারণে মালিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেশ ছেড়েছেন, সে বিষয় জানেন না তিনি।
এ বিষয়ে আদমজী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মসিউদ্দিন বিন মেজবাহ শেয়ার বিজকে বলেন, এ-টাইপ একটি প্রতিষ্ঠান। হংকংভিত্তিক মালিক তিন বছর আগে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে চলে গেছেন।