রপ্তানি না করেই প্রণোদনার অর্থ লোপাটে ডো এম্পেক্স

রহমত রহমান: পণ্য রপ্তানি করা হয়নি। অথচ তৈরি পণ্য রপ্তানির ভুয়া বিল অব এক্সপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। রপ্তানির টাকাও দেশে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে জানিয়ে নেয়া হয়েছে প্রণোদনা। ডো এম্পেক্স নামক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে দেখানো হয়েছে রপ্তানি। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং এজেন্টের পারস্পরিক যোগসাজশে এ জালিয়াতি করা হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এ জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও প্রতিষ্ঠানের নামে চারটি পৃথক ফৌজদারি মামলা করেছে। প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এসব মামলা পিবিআই, সিআইডি বা র‌্যাবকে দিয়ে তদন্ত করানোর সুপারিশ করেছে কাস্টম হাউস। সম্প্রতি কাস্টম হাউস থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, রাজধানীর বিজয়নগর এলাকার আকরাম টাওয়ারের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডো এম্পেক্স লিমিটেড ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অ্যাগ্রো প্রসেসিং ফুড ঘোষণায় কাস্টমসে ৪৫টি বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করে। তবে প্রতিষ্ঠানটি কোনো পণ্য রপ্তানি করেনি বলে তথ্য পায় কাস্টম হাউস। বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা বিল অব এক্সপোর্টের পণ্য প্রাইভেট কনটেইনার ডিপোতে রপ্তানির উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছে কি নাÑতা যাচাই করতে কনটেইনার ডিপোতে চিঠি দেয় কাস্টম হাউস। ডিপো হতে জানানো হয়, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডো এম্পেক্স লিমিটেডের ৩০টি বিল অব এক্সপোর্টের পণ্য ডিপো থেকে রপ্তানি করা হয়নি। অথচ প্রতিষ্ঠানটি ৩০টি চালানের পণ্য রপ্তানি না করে জালিয়াতির মাধ্যমে সরকার থেকে আর্থিক প্রণোদনা গ্রহণ করেছে।

কাস্টম হাউস সূত্রমতে, ডো এম্পেক্সের ৪৫টি রপ্তানি পণ্য চালানের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে কাস্টম হাউস। তদন্তে দেখা যায়, শুধু ডো এম্পেক্সই নয়, ফুড স্টাফ জাতীয় খাদ্যপণ্য এবং ফ্রেশ পটেটোর ৮৭২টি চালানে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে। এসব চালানে প্রতিষ্ঠানগুলো ৩৩ কোটি ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩৪ টাকা সরকারি রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতি ডলার ৮৭ টাকা হিসাবে রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাতের পরিমাণ ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ২৭৩ ডলার। এসব চালানে ২ কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার ২৯ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি দেখানো হয়। ৮৭২টি চালানের মধ্যে ১৯১টি ফ্রেশ পটেটো এবং বাকি ৬৮১টি ফুড স্টাফ পণ্য দেখানো হয়েছে।

৩০টি ভুয়া রপ্তানি পণ্য চালানের বিল অব ল্যাডিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৩টি শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ওশান ফ্রেইট সিস্টেম, এভারেস্ট গ্লোবাল লজিস্টিকস ও গ্রিন ভিউ লজিস্টিকস। প্রতিষ্ঠানগুলো চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। ৩০টি পণ্য চালানে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে ছিল কেএইচএল এক্সিম লিমিটেড, একে এন্টারপ্রাইজ-২০০৬, জিআর ট্রেডিং করপোরেশন সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেড, এঅ্যান্ড ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং প্যান বেঙ্গল এজেন্সিজ লিমিটেড।

চিঠিতে বলা হয়, ডো এম্পেক্স ৩০টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে কোনো প্রণোদনা গ্রহণ করেছে কিনাÑতা যাচাই করতে কাস্টম হাউস অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডকে চিঠি দেয়। অগ্রণী ব্যাংক থেকে জানানো হয়, ডো এম্পেক্স ৩৩টি বিল অব এক্সপোর্টের মধ্যে তিনটি রপ্তানি সম্পন্ন হয়েছে। যার রপ্তানি মূল্য ৪৯ হাজার ৮২০ ডলার। বাকি ৩০টি বিল অব এক্সপোর্টের পণ্য রপ্তানি হয়নি, যার রপ্তানি মূল্য ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৪ ডলার। ৩০টি বিল অব এক্সপোর্টের মধ্যে একটি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে কোনো ডলার দেশে আসেনি। বাকি ২৯টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে ১৯ লাখ ৯ হাজার ২১০ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে প্রণোদনা লোপাট করেছে প্রায় তিন কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ রপ্তানিকারকের সঙ্গে ৫টি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ৩টি শিপিং এজেন্ট বা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট এবং শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় কিছু কাস্টমস কর্মকর্তার পারস্পরিক যোগসাজশের প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস।

আরও বলা হয়, বক্তব্য জানতে ডো এম্পেক্সের মালিক বা প্রতিনিধিকে শুনানিতে ডাকা হলেও তারা অংশ নেয়নি। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি শুনানিতে অংশ নিয়ে জানান, তাদের প্রত্যেকের পাসওয়ার্ড অন্য কেউ ব্যবহার করে বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করেছে।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ফ্রেইট ফরওয়ার্ড এজেন্টদের পারস্পরিক যোগসাজশে এ জালিয়াতি হয়েছে। এছাড়া বিল অব এক্সপোর্টে যে কাস্টমস কর্মকর্তার সই রয়েছে, তারা জড়িত কিনা তা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে, যা চলমান। জালিয়াতির অভিযোগে সীতাকুণ্ড থানা, পাহাড়তলী থানা, পতেঙ্গা থানা ও বন্দর থানায় পৃথক চারটি মামলা করেছে কাস্টম হাউস।

কমিশনার সই করা চিঠিতে বলা হয়, একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান একই ধরনের অপরাধ, কিন্তু অপরাধ সংগঠনের স্থানের ভিন্নতার কারণে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়েছে। চারটি মামলা একই ধরনের এবং একই রপ্তানিকারক বিধায় তদন্তের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে জালিয়াতি চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য মামলাগুলো পিবিআই, সিআইডি বা র‌্যাবের মাধ্যমে তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী এনবিআর থেকে জননিরাপত্তা বিভাগ সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ অধিদপ্তরকে অনুরোধ করতে চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া একই সঙ্গে মানি লন্ডারিং বিষয়ে এনবিআর, দুদক ও বিএফআইইউকে যৌথভাবে তদন্ত করা যেতে পারে বলে চিঠিতে বলা হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০