রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি বাড়াতে নীতি সংস্কারের বিকল্প নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা সংকটের মধ্যেও ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে সামনে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে রফতানির বিপুল প্রবৃদ্ধি। বৈশ্বিক মন্দা সত্তে¡ও বাংলাদেশের রফতানি গত দশকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কিন্তু রফতানির এ প্রবৃদ্ধি নানামুখী ঝুঁকির মুখে রয়েছে। শুধু পোশাকের ওপর নির্ভর করে রফতানিনির্ভর এই জাতীয় প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। এজন্য রফতানির বৈচিত্র্যকরণ জরুরি। রফতানি প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা নীতিগত অবস্থা। পোশাক খাতে যেসব নীতিসুবিধা রয়েছে, সেগুলো অন্য খাতে দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) আয়োজিত ‘রফতানি বৈচিত্র্যকরণের চ্যালেঞ্জ ও রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি বাড়াতে নীতি সংস্কারের বিকল্প নেই অগ্রাধিকার’ শীর্ষক আলোচনায় এসব কথা বলেন বক্তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ও শিল্পপতি সালমান এফ রহমানের সভাপতিত্বে রফতানিসংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। বিইআই’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, অন্যান্য দেশের মতো সম্পদ আমাদের নেই। তবুও আমাদের দেশে রফতানি ও রিজার্ভ বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা এখানে ঘাটে ঘাটে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসার পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এ বছর এক ধাপ অবনতি হয়েছে। এতে আমি খুবই দুঃখিত। আসলে সরকারের তরফে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। রফতানি বৈচিত্র্যকরণের জন্য আমাদের অনেক উদ্যোগ আছে। তবে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ ও লাভের অবস্থা থাকতে হবে। আমরা চাইলেই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন না। অস্ট্রেলিয়া আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, ভারত দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা চান ইউরোপ আর আমেরিকা। এ অবস্থা মাথায় নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে। তবে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি অন্য সব খাতের প্রতি আমাদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।’

সভায় ‘বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের পুনর্ভাবনা: প্রবৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যকরণের জন্য নীতি’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ এ রাজ্জাকের উপস্থাপিত ওই গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের রফতানি ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও মাথাপিছু রফতানি অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাসের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাপক একটি কর্মপরিবেশ ও কমপ্লায়েন্স-সংক্রান্ত চাপের মধ্যে রয়েছে। নতুন পণ্যের রফতানি বৃদ্ধিতেও অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ দেশের রফতানি আয়ের ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও তা হয়েছে আনুভ‚মিক। অন্যদিকে ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো দেশে উল্লম্বভাবে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রফতানি বৃদ্ধির জন্য রফতানিবিমুখ নীতির সংস্কার করা প্রয়োজন। তৈরি পোশাক ছাড়াও অন্যান্য খাতের রফতানি বৃদ্ধিতে নীতি-সহায়তা জরুরি। এছাড়া আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি রফতানির জন্য সহজ নীতিমালাও বড় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রণোদনা সম্পর্কে সভাপতির বক্তব্যে সালমান এফ রহমান বলেন, প্রথম যখন প্রণোদনা চাওয়া হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল, এটা অপব্যবহার হবে। অপব্যবহার কিছুটা হয়েছে। কিন্তু এর সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। আজকের এ ৩৮ বিলিয়ন রফতানি প্রণোদনার কারণে সম্ভব হয়েছে। সভায় অন্যদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, এফবিসিসিআই’র সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম, পিআরআই’র চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিপি) ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে আগে আমাদের দেশের অর্থনীতির আচরণটা বুঝতে হবে। আমাদের দেশের রফতানিতে শিল্প খাতের প্রাধান্য থাকলেও এখানে কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের পণ্যের মান কম। বাংলাদেশের পণ্যের ভ্যালু বাড়ানোর পাশাপাশি আশপাশের পণ্যবাজারের ভ্যালু চেইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এখন প্রয়োজন। এদেশের পোশাক খাতের জন্য ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা উম্মুক্ত করা হয়েছিল। এ দুটি নীতি-সহায়তার কারণেই আজ বাংলাদেশের পোশাক খাত এতটা সমৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছিল। এখন এ সুবিধাগুলো অন্যান্য খাতেও দেওয়া প্রয়োজন। সভায় উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, এসব সুবিধা অন্যান্য খাতের জন্যও দিতে আগ্রহী সরকার। তাছাড়া সেবা খাতের রফতানির দিকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। বিডা চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের এখনকার মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬০০ ডলার। উন্নত দেশ হতে হলে আয় হতে হবে ১৫ হাজার ডলার, যা খুবই বড় লক্ষ্যমাত্রা। ১০-২০ হাজার টাকার কর্মসংস্থান করে এ লক্ষ্য অর্জন হবে না। আমাদের ১২ লাখ টাকা মাথাপিছু আয়ের দেশ হতে হবে। এজন্য আমাদের আগের অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছি যে অভিনব উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশ সক্ষম। আর ভবিষ্যতে হয়তো পোশাক খাতের উদ্যোক্তারাও আরও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর খাতের দিকে আগ্রহী হবে সময়ের দাবিতে। এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দক্ষতার অভাব। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কিন্তু তারপর প্রশিক্ষিত কর্মীরা কোথায় যায় তার কোনো ফলোআপ হয় না। দেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। তারপরও চট্টগ্রামে মাত্র চারটা ক্রেন দিয়ে এত রফতানি অর্জন সম্ভব নয়। সরকারের কর্মকর্তারা একটু সহযোগিতা করলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পেতাম। তাহলেই রফতানির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০