জাকারিয়া পলাশ: দেশের মোট রফতানির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে। প্লাস্টিক পণ্যের রফতানিও বেড়েছে ডলারের হিসাবে। বহুমাত্রিক প্লাস্টিক শিল্পের আধুনিকায়নও ঘটেছে গত এক যুগে। নানা ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। তবে মোট জাতীয় রফতানির তুলনায় প্লাস্টিক পণ্যের রফতানির হার বাড়েনি। গত ১৩ বছর ধরেই প্লাস্টিক পণ্যের রফতানির হার মোট রফতানির দেড় শতাংশের আশপাশে থাকছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে প্লাস্টিক খাতের মোট রফতানি হয় ১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ওই বছর দেশের মোট রফতানি ছিল ৭৬০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সে হিসাবে মোট জাতীয় রফতানির মধ্যে প্লাস্টিক খাতের অবদান ছিল ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। ১৩ বছর পেরিয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেখা যায় খাত থেকে আসা রফতানি আয় ৫১ কোটি ডলার। অর্থাৎ ডলারের হিসাবে প্লাস্টিকের রফতানি বেড়েছে পাঁচ গুণ। একই সময়ে জাতীয় রফতানির পরিমাণও বেড়েছে পাঁচ গুণই। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ৩৪ বিলিয়ন ২৫ কোটি ডলার। এতে প্লাস্টিক খাতের শেয়ার ছিল ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
সদ্য সমাপ্ত আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক মেলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বুয়েটের দুই গবেষক গত ১৩ বছরের রফতানির হিসাব তুলনা করে দেখিয়েছেন, ওই সময়ে জাতীয় রফতানির মধ্যে প্লাস্টিক খাতের অবদান ছিল সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ২০০৪-০৫ অর্থবছরে। অন্যান্য বছরও দেড় শতাংশের আশপাশেই ছিল। এ হিসাবটি করা হয় প্লাস্টিকের সরাসরি রফতানি ও প্রচ্ছন্ন রফতানির পরিমাণ মিলিয়ে।
বাংলাদেশের প্লাস্টিক খাতের বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক প্রতিবেদনে ড. মো. সিরাজুল ইসলাম ও ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহমুদুল হাসান ইমন আরও লিখেছেন, ১৯৬০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশের প্লাস্টিক খাতে নতুন নতুন প্রযুক্তির সংযোজন ও ব্যবহার হয়ে আসছে। ২০১০ সালে এসে সর্বাধুনিক সিএনসি মেশিনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়। এছাড়া প্রতি বছরই নতুন নতুন প্রযুক্তি ও বাজারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে খাত। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাতটি কিছুতেই জাতীয় রফতানিতে বড় ধরনের অবদান রাখছে না।
সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা দাবি করেন, হিসাবের জটিলতার কারণে প্রকৃত পরিমাণ দেখানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের প্লাস্টিকের রফতানি প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর এবং ইপিবির তথ্যে শুধু সরাসরি রফতানি চিত্র তুলে ধরা হয়। প্লাস্টিকের একটি বিরাট অংশ, যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা, প্রচ্ছন্ন রফতানি হয় গার্মেন্ট ও অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে অ্যাকসেসরিজ হিসেবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, প্রচ্ছন্ন ওই রফতানিকে হিসাবে না আনার কারণে রফতানির পরিমাণ কম হওয়ার পাশাপাশি রফতানিকারকরা এ-সংক্রান্ত সুবিধাদিও পাচ্ছেন না। এছাড়া প্লাস্টিক রফতানিতে আরও কিছু সমস্যা রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। জসিম উদ্দিন বলেন, ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে প্লাস্টিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে প্লাস্টিকে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেওয়া হলেও বন্ডেড প্রতিষ্ঠানকে তার আওতায় রাখা হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্টরা সুবিধা পাচ্ছেন না।
রফতানি বৃদ্ধি না হওয়ার আরও কারণ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্রমতে, দেশের প্লাস্টিক উৎপাদকরা নিজস্ব ডিজাইনের পণ্য উৎপাদন করেন না। দীর্ঘদিন ধরেই তারা বিদেশি বিভিন্ন নকশার অনুকরণে পণ্য তৈরি করে দেশের বাজারে ছাড়েন। নিজস্ব নকশার উদ্ভাবন ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপকহারে রফতানি করা সম্ভব নয়। এদিকে প্লাস্টিকের আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে বিপিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘অটোমোবাইল খাতে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়। আমাদের দেশে অটোমোবাইল খাত না থাকায় সেই বাজারটিতে আমরা অংশ নিতে পারছি না। এছাড়া প্লাস্টিকের খেলনার একটি বিশাল বাজার রয়েছে বিভিন্ন দেশে, যার প্রায় ৯০ শতাংশ চীনের দখলে।’
খেলনা তৈরির দিকে মনোযোগ দিলে প্লাস্টিক খাতের রফতানি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এজন্য খেলনা আইটেমের ওপর ভ্যাট কমানোর দাবি করেন তারা। এছাড়া নিজস্ব উদ্ভাবনী দক্ষতার গুরুত্ব স্বীকার করেন তারা।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে খাতের ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, দেশের বাজারে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে। এরই মধ্যে প্রায় ১৫টি পণ্যের প্যাকেজিংয়ের জন্য পাটপণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে নাখোশ প্লাস্টিকের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্লাস্টিককে পাটের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো ঠিক নয়। পাট ও প্লাস্টিকÑ উভয় খাতের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য একটি সার্বজনীন প্যাকেজিং অ্যাক্ট করার দাবি করেছেন তারা।
রফতানির দেড় শতাংশে আটকে আছে প্লাস্টিক খাত

Add Comment