জাকারিয়া পলাশ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে রফতানিনির্ভর। কিন্তু দেশি পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি এবং পুরোনো বাজারে নতুন নতুন পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) চেয়েও নিচে। গত দেড় দশকে দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধিতে নতুন পণ্যের অবদান দেখা গেছে পাঁচ শতাংশেরও নিচে। তাছাড়া প্রচলিত পণ্যের রফতানি বন্ধ বা পণ্যমৃত্যুও (প্রোডাক্ট ডেথ) হচ্ছে ব্যাপক হারে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) একটি গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ‘বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের পুনর্ভাবনা: প্রবৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যকরণের জন্য নীতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধটি প্রস্তুত করেছেন বিইআইর গবেষক ড. মোহাম্মদ এ রাজ্জাক। এতে ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে বলা হয়, রফতানি বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেকাংশে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের শিল্প খাতগুলো।
রফতানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। সেগুলো হলো, বিদ্যমান পণ্যগুলোর রফতানি অব্যাহত রাখা, পণ্য তালিকায় নতুন পণ্য সংযুক্ত করা (বৈচিত্র্যকরণ) এবং কোনো পণ্যের রফতানি শুরুর পর তা বন্ধ (পণ্যের মৃত্যু) না হওয়া। কিন্তু তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণায় দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধিতে নতুন পণ্যের অবদান অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম। তথ্যমতে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশের রফতানিতে নতুন পণ্যের অবদান পাঁচ শতাংশের নিচে। এছাড়া পণ্যের মৃত্যুর হার দেখা গেছে প্রায় চার শতাংশ। সে হিসাবে প্রচলিত পণ্যের বাইরে নিট রফতানি হয়েছে মাত্র এক শতাংশ।
তথ্যমতে, এশিয়ার অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের মধ্যে ওই সময়কালে রফতানির প্রবৃদ্ধিতে নতুন পণ্যের সর্বাধিক অবদান দেখা গেছে মালয়েশিয়ায়। দেশটির রফতানি প্রবৃদ্ধির ৭৮ শতাংশ আসছে নতুন পণ্য থেকে। এছাড়া ভিয়েতনামে ৪২ শতাংশ ও চীনে ৩২ শতাংশ অবদান রয়েছে নতুন পণ্যের। এছাড়া পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া ও ভারতেও মোট রফতানিতে নতুন পণ্যের অবদান বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
গবেষণায় আরও দেখানো হয়, ২০০১ সালের পর থেকে ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ তার রফতানির পরিধি খুব সীমিত ভিত্তি থেকে বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। দেখা গেছে, পণ্যগুলোর বাণিজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে তা বিশ্বের মোট আন্তদেশীয় বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ দখল করে আছে। অর্থাৎ আরও প্রায় ৪০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত নয়। এছাড়া এ ৬০ শতাংশ বাণিজ্যের মধ্যেও বাংলাদেশের অংশীদারত্ব এক শতাংশেরও কম, যা খুব সামান্য। অন্যদিকে ভিয়েতনামের প্রোডাক্ট লাইন প্রায় ৯০ শতাংশ বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া তাদের মার্কেট শেয়ারও বেশি। ভারতের ক্ষেত্রে এ বিস্তার উল্লম্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের গবেষক মোহাম্মদ এ রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআইি) দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়ে একটি গবেষণামূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এ গবেষণাটি করা হয়েছে। এতে অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত¡ ও কৌশল প্রয়োগ করে বাংলাদেশের রফতানির সম্ভাবনা ও বৈচিত্র্যকরণের সম্ভাবনাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে অন্য সাতটি দেশের চেয়ে পশ্চাৎপদ দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থার কিছু বৈচিত্র্য আছে। অন্যান্য দেশের রফতানি পণ্যের জন্য কাঁচামাল দেশের মধ্য থেকেই সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশের রফতানিতে শিল্প খাতের প্রাধান্য থাকলেও এখানে কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের পণ্যের মানও কম। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েই বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব।’
এদিকে গবেষণায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশের রফতানিকারকদের অনেকেই একবার রফতানি করার পর ধারাবাহিকতা রাখতে না পেরে ব্যবসা ছেড়ে দেন। তথ্যমতে, চীন, ভারত ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের ব্যবসায় টিকে থাকার হার কম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন রফতানি সম্পর্ক স্থাপনের পর তার প্রায় ৬০ শতাংশই দুই বছরের মধ্যে রফতানি বন্ধ করে দেন। অর্থাৎ রফতানি সম্পর্ক টিকে থাকার হার এখানে ৪০ শতাংশ, যা ভারত ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ এবং চীনের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশের মতো। এদিকে পণ্যের রফতানি অব্যাহত থাকার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে পিছিয়ে পড়ার তথ্য। বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে রফতানি হওয়া পণ্যগুলোর প্রায় ২৫ শতাংশ ২০১৫ সালে এসে আর রফতানি হচ্ছে না, অর্থাৎ রফতানির বাজারে এসব পণ্যের মৃত্যু হয়েছে। এগুলোও রফতানির প্রবৃদ্ধি হ্রাসের বড় কারণ।