রবিঠাকুরের পদধূলি সিংহবাড়িতে

১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর (বাংলা ২০ কার্তিক, ১৩২৬)। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বেড়াতে এসেছিলেন শিলং শহরে। ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক গোবিন্দনারায়ণ সিংহ ছিলেন কবিগুরুর একান্ত অনুরাগী। কবি শিলংয়ে এসেছেন এ কথা শুনে তাকে সিলেটে আনার জন্য গোবিন্দনারায়ণ সিংহের খুব ইচ্ছা হলো। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষ থেকে কবিকে সিলেটে আসার আমন্ত্রণ জানান। সিলেট থেকে প্রেরিত নিমন্ত্রণ বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন রবিঠাকুর। বলেন, সিলেটে আশা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ দীর্ঘ ভ্রমণ বিরক্তিকর। কবির অসম্মতি জানার পরও গোবিন্দনারায়ণ সিংহ ক্ষান্ত হননি। কবির নেতিবাচক উত্তর পেয়ে তিনি আনজুমান ইসলাম, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কয়েকটি টেলিগ্রাম পাঠান। আবেগঘন টেলিগ্রামগুলো কবির হƒদয়কে প্রভাবিত করে। অবশেষে সিলেটে আসতে রাজি হন তিনি।
৩১ অক্টোবর কবিগুরু শিলং থেকে গুয়াহাটি অভিমুখে যাত্রা করেন। কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। সেখানে তিন দিন থাকার পর ৩ নভেম্বর গুয়াহাটি থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেন। গুয়াহাটি থেকে সিলেটের পথে সব স্টেশনে কবিকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়। ট্রেন কুলাউড়া জংশনে পৌঁছালে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তার সহযাত্রীরা কুলাউড়াতে রাতযাপন করেন।
কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য অভ্যর্থনা পরিষদ গঠন করা হয়। সভাপতি নিযুক্ত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ। ৫ নভেম্বর সকালে ট্রেন সিলেট স্টেশনে পৌঁছালে কবিগুরুকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অভ্যর্থনা জানাতে খানবাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ, মৌলভী আবদুল করিম, রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্তসহ এহিয়া ভিলা, কাজী বাড়ি, মজুমদার বাড়ি ও দস্তিদার বাড়ির অভিজাত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকেন। সিলেট মহিলা সমাজের পক্ষে অভ্যর্থনা জানান নলিনীবালা চৌধুরী।
সুরমা নদীর ওপর ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ তখনও হয়নি। কবিগুরু ও তার সঙ্গীরা বজরায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে মূল সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীঘাটকে পত্র-পুষ্প পতাকা, মঙ্গলঘট আর লালসালু দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। মৌলভী আবদুল করিমকে নিয়ে কবিগুরু একটি ফিটন গাড়িতে চড়ে শহরের উত্তর-পূর্বাংশের ছোট টিলার ওপর পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলোর পাশে একটি বাড়িতে যান। সেখানে পৌঁছালে কবিকে সঙ্গীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় ব্রাহ্ম সমাজের আমন্ত্রণে কবি তাদের উপাসনায় যোগ দেন। পরদিন ৬ নভেম্বর সকালে লোকনাথ টাউন হলে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সৈয়দ আবদুল মজিদ। একই দিন দুপুরে মুরারীচাঁদ কলেজের (বর্তমানে এমসি কলেজ) বাংলা ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে কবি তার বাড়িতে যান। বেলা ২টায় ব্রাহ্মসমাজগৃহে সিলেট মহিলা সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেন। এরপর কবি শহরের উপকণ্ঠে মাছিমপুর এলাকায় মণিপুরী পল্লিতে যান। কবির সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী রমণী কর্তৃক পরিবেশিত রাশনৃত্যে মুগ্ধ হন। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিগুরু পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য চালু করেছিলেন।
৭ নভেম্বর সকালে সিংহবাড়িতে আসেন কবি। সিলেট শহরের বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার পেরিয়ে চৌহাট্টায় অবস্থিত সিংহবাড়ি। প্রবেশদ্বারেই সিংহবাড়ির নামফলক। শহর জীবনে এক অন্যরকম পরিবেশ। পুকুরে শান বাঁধানো ঘাট। চারপাশে গাছগাছালির ছায়া। এ যেন অন্যরকম পরিবেশ নগর জীবনে। শহুরে জীবনে ছায়া ঘেরা একটি পরিবেশ। একদিকে পাখিদের কুহু-কূজন শব্দ, অন্যদিকে নগরজীবনের যান্ত্রিকতার ছোঁয়া। সব মিলিয়ে এক অন্যরকম পরিবেশ। এখানে প্রথমে দেখতে পাবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ঘরে উপাসনা করেন, সে ঘরটি।

যেভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি পরিবহনের বাস অথবা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তঃনগর পারাবত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন ট্রেনে চড়ে সিলেটে যাওয়া যাবে। সেখান থেকে চৌহাট্টায় সিংহবাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাবেন।

শিপন আহমেদ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০