রবির আর্থিক অবস্থা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিনিয়োগকারীরা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পুঁজিবাজার থেকে সম্প্রতি অর্থ সংগ্রহ করার অনুমোদন পেয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি রবি আজিয়াটা। পুঁজিবাজার থেকে ৫২৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে কোম্পানিটি। বর্তমানে কোম্পানিটির আইপিওর আবেদন চলছে। এর মধ্য দিয়ে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করছে। প্রায় ১০ বছর পর বহুজাতিক কোম্পানিটির পুঁজিবাজারে আসার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রবির নামের যে খ্যাতি রয়েছে, সেই তুলনায় ভালো নেই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা। কোম্পানিটির আয়-মুনাফায়ও কোনো ধারাবাহিকতা নেই, যে কারণে এই কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাজারে এসে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

রবি আজিয়াটার আর্থিক বিবরণীতে দেখা যায়, সর্বশেষ পাঁচ বছরের মধ্যে দুই বছর লোকসানে ছিল কোম্পানিটি। এর মধ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে লোকসানে ছিল। ২০১৬ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করে ৬৯৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। পরের বছর লোকসান কমে দাঁড়ায় ১০ কোটি ৪৬ লাখ টাকায়। পরে ব্যবসায়িকভাবে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে লাভে ফিরে আসে কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে কোম্পানিটি মুনাফা করে ১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর আগের বছর (২০১৮ সালে) মুনাফা ছিল ২১৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৯ সালে আগের চেয়ে মুনাফা অস্বাভাবিকহারে কমে গেছে।

যদিও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির আয় বেড়েছে। এ সময় কোম্পানিটির রাজস্ব আয় দাঁড়ায় সাত হাজার ৪৮১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৭৯৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তবে ২০১৮ সালে রবির আয় কমে যায়। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির আয় ছিল ছয় হাজার ৮২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৬ সালেও কোম্পানিটির আয় কমে।

যদিও করোনার কারণে চলতি বছর কোম্পানিটির আয় ও মুনাফা কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানিটি যদি কোনো কারণে আবারও ব্যবসায় খারাপ করে তাহলে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণে বেগ পেতে হবে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাজার বিশ্লেষক বলেন, আর্থিক অবস্থার বিবেচনায় কোম্পানিটি খুব ভালো অবস্থানে নেই। তবে বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে এর সুনাম রয়েছে। এই ধরনের কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্তির প্রয়োজন আছে। প্রতিষ্ঠানটি যদি বাজারে এসে ভালো ব্যবসা করতে পারে, তাহলে হয়তো তারা বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, একটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে গতিবিধি কেমন তা বুঝতে অনন্ত এক বছর সময় লাগে। যেসব কোম্পানির সুনাম রয়েছে, সে ধরনের কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি থাকে। এই ক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানি আরও এগিয়ে থাকে। রবি বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারবে, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

অজিয়াটার তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর শেষে দেশে রবির সেবাগ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ কোটি এক লাখ ২৬ হাজার, যা দেশের মোট গ্রাহকসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। মালয়েশিয়ার কোম্পানি আজিয়াটা রবির ৬৮ দশমিক সাত শতাংশ শেয়ারের মালিক।

৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৯ হিসাববছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিসাববছর শেষে পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া রবির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ৬৪ পয়সা। উল্লেখ্য, আলোচ্য সময়ের জন্য কোনো সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করেনি কোম্পানিটি। সমাপ্ত হিসাববছরে রবির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে মাত্র চার পয়সা। আর গত পাঁচ হিসাববছরের গড় হারে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৩ পয়সা।

এ বিষয়ে জানার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও বরির পক্ষ থেকে কোনো অফিশিয়াল বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কোম্পানিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রবি আসলে কখনোই লোকাসানে ছিল না। এয়ারটেলের সঙ্গে মার্জার করার কারণে আমাদের অনেক অর্থ খরচ হয়। এর পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। তাছাড়া ওই সময়ে বন্যার কারণেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই, যে কারণে দুই বছর লোকসান দিতে হয়েছে। তাছাড়া রবি কখনও লোকসানে যায়নি।’

প্রসঙ্গত, ইলেকট্রনিক সাবস্ক্রিপশন সিস্টেমের মাধ্যমে কোম্পানিটির সাধারণ শেয়ারের চাঁদা প্রদানে ইচ্ছুক প্রত্যেক যোগ্য বিনিয়োগকারীকে চাঁদা গ্রহণ শুরুর দিন থেকে পূর্ববর্তী পঞ্চম কার্যদিবস শেষে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে ন্যূনতম এক কোটি টাকা বিনিয়োগ থাকতে হবে।

রবির ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড। চলতি বছরের ২ মার্চ ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতির আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার অনুমোদনের জন্য বিএসইসি বরাবর আবেদন করে সেলফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা। কোম্পানিটির পক্ষে আবেদনপত্র দাখিল করে ইস্যু ম্যানেজার আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টস।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে রবি আজিয়াটা লিমিটেডকে ১০ টাকা ইস্যু মূল্যে ৫২ কোটি ৩৭ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৪টি সাধারণ শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ টাকা সংগ্রহ করবে রবি।

দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আইপিও শেয়ার ইস্যু করতে যাচ্ছে রবি। মোট ৫২ কোটি ৩৭ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৪টি সাধারণ শেয়ারের মধ্যে ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার ৯৩৪টি শেয়ার কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে ইস্যু করা হবে। টাকার অঙ্কেও তাদের আইপিও সর্বোচ্চ। এর আগে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওর মাধ্যমে ৪৮৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকার পুঁজি সংগ্রহ করেছিল এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড। আইপিওর মাধ্যমে উত্তোলিত তহবিল থেকে রবি ৫১৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও বাকি আট কোটি দুই লাখ টাকা আইপিওর ব্যয় নির্বাহ খাতে খরচ করবে।

গ্রামীণফোন লিমিটেডের পর দ্বিতীয় মোবাইল অপারেটর হিসেবে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে রবি। ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতির আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৪৮৬ কোটি সাত লাখ ৫৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছিল গ্রামীণফোন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০