পবিত্র রমজানুল মোবারকের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছি আমরা। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে মাসটি নেকি (পুণ্য) অর্জনের বসন্তকাল হিসেবে পরিচিত। এ পবিত্র মাসের সাহরি ও ইফতারের কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন শিপন আহমেদ ও কামরুন নাহার ঊষা
পবিত্র মাহে রমজানে জীবনযাপনে বেশ পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে খাবারদাবারের পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়। রমজানের ফজিলত বা উপকারিতা বহুবিধ। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাস্থ্য। অন্য সময়ের তুলনায় রমজানে স্বাস্থ্যের বেশ উপকার হয়।
রমজানে এবাদতের মতো একটি সুকর্ম সম্পন্ন করতে হয়, যার প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। সারা বছর ধরে শরীরে জমে যাওয়া মেদ বা চর্বি ভেঙে যায়। অর্থাৎ শরীরে জমে যাওয়া ক্ষতিকর পদার্থগুলো মলমূত্র, ঘাম প্রভৃতির সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এতে চর্বি কমে যায়, ফলে কোলেস্টেরল হ্রাস পায় এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। কয়েক দিন রোজা পালনের পর রক্তে এনডোরফিনসের মতো কয়েকটি হরমোনের মাত্রা বাড়ে, যে হরমোন মানুষকে অধিক সক্রিয় করে এবং শরীর ও মনকে প্রফুল্ল রাখে।
সাহরির পর থেকে ইফতার পর্যন্ত উপোস থাকলেও প্রকৃতপক্ষে রোজার স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কার্যকারিতা শুরু হয় সাহরির আট ঘণ্টা পর থেকে। কারণ সাহরির পর আট ঘণ্টা পর্যন্ত ওই খাবার হজম হতে থাকে ও তা থেকে শরীরে শক্তি সরবরাহ করে। আট ঘণ্টা পর সাহরির প্রভাব সরাসরি থাকে না। তখন থেকে লিভার ও মাংসপেশিতে আগের জমে থাকা গ্ল–কোজ ভেঙে শক্তি উৎপন্ন হয়। গ্লুকোজ শেষ হয়ে গেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে জমে থাকা চর্বি ভেঙে শক্তি তৈরি হয়। এসব প্রক্রিয়াই শরীরের জন্য খুব উপকারী, যা রোজার মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব। তবে না খেয়ে থাকাটা যদি ২৪ ঘণ্টার বেশি হয়, তাহলে মাংসপেশি শুকাতে পারে। সে প্রক্রিয়া কিন্তু শরীরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
রমজানে তারাবি ও নফল নামাজের উপকারিতা অনেক। আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভ ছাড়াও শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং মনে প্রশান্তি আনতে তারাবি নামাজ বিশেষ সহায়ক। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক তিন কিলোমিটার হাঁটা বা দৌড়ানোর সমান পরিশ্রম হয় তারাবি নামাজ পড়লে। অন্যান্য নামাজের মতো তারাবিও দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যালরি বার্ন তথা শক্তিক্ষয় করে। ক্ষুধার উদ্রেক করে ও মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনে। তাই রমজানে নিয়মিত তারাবি নামাজ পড়া ও অন্তত ফজরের নামাজ শেষে কয়েক রাকাত নফল আদায় অশেষ সওয়াবের পাশাপাশি মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষ কার্যকর।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী যদি রোজা পালন করা যায়, তাহলে শারীরিক নানা ধরনের উপকার পাওয়া যাবে। বলা হয়ে থাকে, রমজান সুস্বাস্থ্য চর্চার মাস। এছাড়া রোজা হতে পারে আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো, মানসিক সুস্থতা, সম্প্রীতি-সাম্যের মনোভাব, মানবতার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কর্মশালা।
রোজায় ডায়াবেটিক রোগীদের করণীয়
সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র মাহে রমজান। শুধু আত্মশুদ্ধিই নয়, এ মাস আত্মনিয়ন্ত্রণেরও। এ সময় অনেক রোগী যেকোনোভাবে রোজা রাখতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকেন। আর রোজা পালন করা মানে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। এ কারণে ডায়াবেটিক রোগীরাও রোজা থাকতে পিছপা হন না।
বিশ্বে প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমান রয়েছেন, জনসংখ্যার ১৮ থেকে ২৫ শতাংশ তারা। তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মানুষ সাধারণত রোজা রাখেন। বর্তমানে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০০ মিলিয়ন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০ মিলিয়নে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। প্রতি রমজানে চার-পাঁচ কোটি ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখেন। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীদের ৪৩ শতাংশ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীদের ৭৯ শতাংশ রমজানে রোজা রাখেন।
রোজায় একজন মানুষকে ভোররাত থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুমভেদে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত অনেকে রোজা রাখেন। আর ডায়াবেটিসের রোগীরা খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম ও ওষুধের নিখুঁত সময়সূচি ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলেন। তাই রমজানে সাহরি ও ইফতারের মধ্যে দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার প্রভাব পড়তে পারে শরীরে। কখনও কখনও তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে কিংবা কমতে পারে। তাই এ সময়ে ডায়াবেটিক রোগীদের কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি।
হাইপো ও হাইপারের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তের সুগার অতিরিক্ত কমে গিয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে প্রস্রাবে সমস্যা, তীব্র মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, গা কাঁপা, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া প্রভৃতি। এসব সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ এ সময় রক্তের সুগার অতিরিক্ত কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসিমিয়া), সুগার অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসিমিয়া), পানিশূন্যতা ও ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস সমস্যা হতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সঙ্গে সঙ্গে শরবত বা মিষ্টিজাতীয় কিছু মুখে দিতে হবে, অথবা মিষ্টি চকোলেট বহন করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তখন স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য রোজা ভেঙে ফেলতে হবে, তা না হলে মৃত্যুঝুঁকিও দেখা দিতে পারে।
ওষুধ ও ইনসুলিন
রমজানে খাবারের সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ওষুধ, ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচি পরিবর্তিত হয়। ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে দিনের ওষুধগুলোর সময় পরিবর্তন করে রাতে তা গ্রহণ করতে হবে, কারণ ওষুধের মাত্রা রক্তে শর্করার পরিমাণের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। এ কারণে নিজে থেকে ওষুধের সময়সূচি পরিবর্তন করা যাবে না। যারা খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করছেন বা মেটফরমিন, ডিপিপি ৪ ইনহিবিটর বা গ্লিটাজন শ্রেণির ওষুধ সেবন করছেন, তাদের জন্য রোজা রাখা বেশ নিরাপদ। আর যারা ইনসুলিন নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন, অর্থাৎ এটি পরীক্ষার জন্য রক্ত দিলে রোজা ভঙ্গ হবে না। নিয়ম অনুযায়ী একজন রোজাদার যেমন ইনসুলিন নেবেন, তেমনি শারীরিক কোনো দুর্বলতা অনুভব করলে সকাল ও বিকালে রক্ত পরীক্ষা করে সুগারের অবস্থা দেখে নিতে পারবেন। কোনোভাবেই যেন হাইপো না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
ইফতার ও সাহরিতে
সকালের খাবার ইফতারে, রাতের খাবার সাহরিতে ও দুপুরের খাবার রাতে খেতে হবে। তাই ইফতারিতে ভাজাপোড়া খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য একেবারেই ভালো নয়। সুতরাং এ ধরনের খাবার না খেয়ে দই-চিড়া, রুটি বা সবজি, এক থেকে দুটা খেজুর ও ফলমূল খেলে শরীরের জন্য ভালো হবে। তবে ইফতারে একসঙ্গে বেশি না খেয়ে ধাপে ধাপে ভাগ করে খান। এতে রক্তে হঠাৎই শর্করার মাত্রা বেড়ে যাবে না। সাহরিতে পোলাও-বিরিয়ানির মতো ভারী খাবারের পরিবর্তে শর্করাজাতীয় স্বাস্থ্যকর ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া উত্তম। ভাতের বদলে আটার তৈরি খাবার বা রুটি খেতে পারলে শরীরের জন্য ভালো। খাবারটি দীর্ঘসময় নিয়ে হজম হয়, তাই এটি খেতে হবে সাহরি শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে।
ইফতার-পরবর্তী খাবার
এ সময়ে খাবার একেবারে বাদ দেওয়া উচিত নয়। কম করে হলেও খেতে হবে। রোগী ভাত খেতে পারবে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বরাদ্দ খাবারের পরিমাণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। হালকা মসলায় রান্না যে কোনো ছোট-বড় মাছ ও সবজি খেতে পারেন। এছাড়া টক ও মিষ্টি উভয় ধরনের ফলের সালাদ খাওয়া যেতে পারে। এতে খনিজ লবণ ও ভিটামিনের অভাব পূরণ হবে। কাঁচা ছোলার সঙ্গে আদাকুচি, টমেটোকুচি, পুদিনাপাতা ও লবণের মিশ্রণ বেশ সুস্বাদু। কাঁচা ছোলা রক্তের কোলেস্টেরল কমানো ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
চিনিযুক্ত শরবত বাদ দিয়ে ডাবের পানি
ইফতারিতে চিনিযুক্ত বিভিন্ন ধরনের শরবত বাদ দিয়ে ডাবের পানি বা ফলের শরবত খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদরা। ইফতারির পর থেকে সাহরি পর্যন্ত যতটা সম্ভব বেশি পানি পান করতে হবে। সাহরিতে ভারী খাবারের পরিবর্তে তরল খাবার খেতে হবে। গরমের সময় রোজা হচ্ছে, তাই সাহরি ও ইফতারের পর বেশি করে পানি পান করা উচিত।
ব্যায়াম
অনেক ডায়াবেটিস রোগী নিয়মিত ব্যায়াম করেন। তাদের রুটিনে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। রোজার সময় ব্যায়ামের পরে খাবার বা পানি পান করা সম্ভব নয়। ফলে শরীরে শর্করার মাত্রা অনেক কমে যেতে পারে। তাই সন্ধ্যার পর অথবা সাহরির আগে হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করতে পারেন।
সাবধানতা
ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য কোনো জটিলতা থাকলে, যেমন:
# কিডনি রোগ ও উচ্চমাত্রার ইউরিক থাকলে ডালের তৈরি খাবার থেকে বিরত থাকুন
# আলসার বা গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা থাকলে ডুবোতেলে ভাজা ও ঝালযুক্ত খাবার পরিহার করুন
# শরীরের ওজন বেশি থাকলে কম খাবার গ্রহণ করুন
# রোজা রেখে অতিরিক্ত হাঁটা বা ভারী ব্যায়াম করা যাবে না। কেননা এতে রক্তের শর্করার মাত্রা নিচে নেমে বিপদ হতে পারে।
রোজার খাদ্যতালিকায়…
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মহিমান্বিত সাধনার মাস রমজান। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এ মাসে খাদ্যতালিকায় বেশ পরিবর্তন আসে। এ বছরও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এবার প্রায় ১৪ ঘণ্টা রোজা রাখতে হচ্ছে। একদিকে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা, অন্যদিকে গ্রীষ্মের দাবদাহ। তাই রোজায় খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত। ইফতার ও সাহরিতে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ ও মাংস রাখাই শ্রেয়। এসব খাবারে রয়েছে দেহের প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল, ক্যালসিয়াম, ফাইবার প্রভৃতি উপাদান। উপাদানগুলো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান জোগান দেওয়ার পাশাপাশি পানিশূন্যতা দূর করে এবং শরীরে ধরে রাখে সতেজতা। সহজে অনুমেয়, সুস্থ থাকার জন্য চাই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার।
ইফতার
সারাদিন রোজা রাখার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। এজন্য ইফতারে দেহ, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুকোষ ঠিক রাখতে যেসব খাবারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক শক্তি পাওয়া যায়, সেসব খাবারের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। সহজে হজম হয় এমন খাবার বেছে নিতে হবে।
ইফতারের খাবার সময়কে দুই ভাগে ভাগ করে খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত। ইফতারে কিছুটা খেতে হবে। আর দ্বিতীয় ভাগ মাগরিবের নামাজের পর খাওয়া উত্তম। একবারে খেলে পরিমাণে বেশি হয়ে যায়। ফলে নানারকম জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
কী খাবেন: খেজুর তিন থেকে চারটি, হালকা গরম সবজি, মাশরুম, চিকেন বা ওটস স্যুপ এক বাটি, সিদ্ধ ছোলা আধা বাটি, মুড়ি, একটি সিদ্ধ ডিম, একটি ফলের জুস; যেমন আখের রস, কচি ডাবের পানি, দইয়ের লাচ্ছি, কয়েক ধরনের ফল ও দই মিলিয়ে তৈরি করা স্মুদি অথবা খেতে পারেন এক গ্লাস লাবাং।
কী খাবেন না
# ভাজাপোড়া, ভারি ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেলে পেটে সমস্যা, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, অবসাদ, আলসার, এসিডিটি, হজমের সমস্যা প্রভৃতি বিষয় ভোগাতে পারে। এতে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই এ ধরনের খাবার যত কম খাওয়া যায়, ততই ভালো
শরবত ইফতারের প্রতিদিনের পানীয়। তবে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত জুস বা শরবত না খাওয়াই ভালো। বাইরের শরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
# চা ও কফির মাত্রা কমাতে হবে। তা না হলে পানিশূন্যতা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ঘুমে সমস্যা হতে পারে
রাতের খাবার
রমজানে রাতের খাবারও সাহরির মতো কিছুটা হালকা থাকতে হবে। ভাত এক কাপ বা দুই পিস রুটি, মাছ বা মুরগি এক টুকরো, সবজি এক কাপ ও সালাদ এক বাটি। ইফতারে বেশি খেয়ে থাকলে সেক্ষেত্রে রাতে ভাত বা ভারি কিছু না খেয়ে হাল্কা খাবার খাবেন। যেমন মিষ্টির পায়েস, পুডিং বা চিড়া-দই অথবা মিক্সড ফল দিয়ে ওটস এক বাটি, প্যানকেক, ফল, ফলের সালাদ, ফলের কাস্টার্ড অথবা খেতে পারেন বেশি করে সবজি দিয়ে নুডুলস, চিকেন মোমো অথবা ঘরে তৈরি মুরগির হালিম।
সাহরি
শরীর সুস্থ রাখার জন্য সাহরির বিকল্প নেই। সাহরির খাবার মুখরোচক, সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া প্রয়োজন। রমজানে স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন করে সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া সেরে নিতে হয় এবং সারাদিনের চলার মতো খাবার প্রয়োজন হয়। তাই সাহরির সময় অতিরিক্ত খাবার খেয়েও সারাদিনের ক্ষুধা মেটানো সম্ভব নয়। তবে খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু খেয়াল রাখলেই ক্ষুধা মেটানো সম্ভব। আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। খাবারে যেন কম তেল ব্যবহার করা হয়। তরকারিতে মসলার পরিমাণও যেন কম থাকে। তাহলে সারাদিন ভালো কাটবে।
কী খাবেন: লাল চালের ভাত এক কাপ, মিক্সড সবজি; যেমন লাউশাক, মিষ্টিকুমড়ো, শসা, পটোল, ঝিঙ্গে, কচুশাক, মাছ বা মুরগি এক টুকরো, ডাল আধা কাপ, দই বা লো ফ্যাট দুধ এক কাপ এবং এক থেকে দুটি খেজুর খেলে সারাদিন কিছুটা পিপাসা কম লাগবে। এছাড়া কেউ ভাত খেতে না চাইলে রুটি, চিড়া-দই, কর্ন ফ্ল্যাক্স-দুধও খেতে পারেন। অনেকে সাহরির সময় একসঙ্গে বেশি পানি খেয়ে ফেলেন, এটা করা যাবে না। ইফতারের পর থেকে সাহরির আগ পর্যন্ত অল্প পরিমাণে পানি বা অন্যান্য তরল খাবার খেয়ে শরীর আর্দ্র রাখতে হবে।
কী খাবেন না: ইফতার থেকে সাহরি পর্যন্ত চা, কফি ও কোমলপানীয় না খাওয়াই উত্তম। হ
সাহরি ও ইফতার হবে সঠিক সময়ে
সারাদিন রোজা রাখার পর মাগরিবের আজানের পরপরই ইফতার করতে হয়। আবার মধ্যরাতে সাহরির জন্য প্রস্তুত হতে হয়। মুসলমানদের জন্য ইফতার ও সাহরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়েই ইফতার ও সাহরি করে নেওয়া উচিত। ইফতার শুরু হওয়ার অন্তত ১০ মিনিট আগে বসে থাকা ইবাদতের অংশ বলে গণ্য হয়। তাড়াহুড়ো করে ইফতার করা অনুচিত। এরকম হলে দেখা যায়, ঠিক সময়ে ইফতার করা অর্থাৎ মুখে কিছু দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
হাদিস শরিফ অনুযায়ী, দেরিতে ইফতার করলে রোজা মাকরুহ হয়। চাকরিজীবীদের এ ক্ষেত্রে একটু বেশিই চাপে থাকতে হয়। অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেই ইফতারের আয়োজনে যোগ দিতে হয়। আর সেটা যদি হয় নারীদের ক্ষেত্রে, তাহলে আরও কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক নারী নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার করতে পারেন না। তাই রোজার শুরুতেই রুটিন করে নিলে কাজটা সহজ হবে।
বিশেষ করে ছুটির দিনের সময়টি কাজে লাগাতে পারেন তারা। পেঁয়াজ, আলু, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা বেশ খানিকটা কেটে রাখতে পারেন রেফ্রিজারেটরে। মসলা বেটে রেফ্রিজারেটরে রাখুন পুরো সপ্তাহের জন্য। মাছ ধুয়ে লবণ ও হলুদ মেখে জিপ লক ব্যাগে ডিপে রাখুন। মুরগি ধুয়ে পরিষ্কার করে টুকরো করে রাখুন। পুরুষদেরও উচিত এ সময়ে যথাসম্ভব ঘরের কাজে সাহায্য করা। বিশেষ করে ইফতার ও সাহরি টেবিলে সাজানোর কাজটি তারা অনায়াসেই করতে পারেন। যেহেতু রোজায় অফিসের সময় বেশ খানিকটা কমিয়ে দেওয়া হয়, তাই চেষ্টা করতে হবে অফিস থেকে এসে ইফতারের আগের কাজগুলো দ্রুত সারিয়ে ফেলা। সাহরির বেলায়ও আগেভাগে কাজ সেরে নিতে হবে। ইফতারের পর থাকে তারাবির নামাজের ব্যস্ততা। এর মধ্যে আবার সাহরির প্রস্তুতিও নিতে হবে।
ইফতারের প্রস্তুতি: ইফতারের অন্তত দুই ঘণ্টা আগে প্রস্তুতি নিন। গৃহিণীরা দিনের শুরু ও কর্মজীবীরা দুপুরের পর বা আগের রাতে ইফতারের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন। সময় বাঁচাতে চার-পাঁচ দিনের ছোলা একসঙ্গে সিদ্ধ করে ফ্রিজে রাখুন। ইফতারের দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগে বের করে নিন। ঘুগনির ডাবলির ক্ষেত্রেও তা-ই। পেঁয়াজুর ডালও বেশ খানিকটা বেটে ডিপ ফ্রিজে রাখুন। ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগে ফ্রিজ থেকে বের করে অন্তত ২০ মিনিট আগে ভেজে নিন। বিশেষ কোনো আইটেম, যেমন হালিম বা পিঠা তৈরি করতে চাইলে তাও আগে প্রস্তুত রাখুন। প্রয়োজনে ইফতারের আগে গরম করে নিন। মচমচে ও ভাজা অবশ্যই সবার শেষে তৈরি করে নিতে হবে, যেন গরম গরম পরিবেশন করা যায়। শরবত, লাচ্ছি, বায়তা প্রভৃতি কিছুটা আগেই তৈরি করে ফ্রিজে রাখুন। ইফতার শুরুর অন্তত ১০ মিনিট আগে টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে ফেলুন।
সাহরির প্রস্তুতি: সাহরির জন্য অন্তত এক ঘণ্টা আগে প্রস্তুতি নেওয়া ভালো। পারলে রাতে শোবার আগেই
সাহরির ভাত রান্না করে রাখুন। এতে বাকি কাজ সহজে সারা যাবে। চাইলে সাহরিতেও রান্না করতে পারেন। তবে হাতে সময় নিয়েই তা করতে হবে। সব ধরনের খাবার পরিবেশনের আগে অবশ্যই গরম করে নেবেন। ঠাণ্ডা খাবারে স্বাদ পাওয়া যায় না; তাই খেতেও ভালো লাগে না। ঝটপট খাবার গরম করতে ব্যবহার করুন মাইক্রো ওভেন। সাহরির শেষ সময়ের অন্তত ৩০ মিনিট আগে খাওয়া শুরু করুন। এভাবে রুটিন অনুযায়ী চলতে পারলে নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার ও সাহরি সুন্দরভাবে পালন করা সম্ভব।