রহস্যময় স্টোন ফরেস্ট

ভ্রমণপিয়াসিদের সবুজ প্রকৃতির প্রতি বেশ টান রয়েছে। প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে চায় তারা। এবার তাদের ভ্রমণটা না হয় একটু ভিন্নই হোক। সবুজ বনে নয়, ভ্রমণ হবে এবার পাথরের বনে। অবাক লাগছে শুনতে, তাই না? বনটা বেশ অদ্ভুত! সেখানে কোনো গাছ নেই, আছে শুধু পাথর। সেই পাথরগুলোর গায়ে আবার সুন্দর করে নকশা করা। বুঝতেই পারছেন, বন বলা হলেও এতে সবুজের আধিক্য তেমন নেই। সত্যিই এমন একটি পাথুরে বন রয়েছে এ বিশ্বে। স্থানটি দখল করে রয়েছে বিশাল বিশাল গগনচুম্বী পাথর।
অনেকের মনে জাগতে পারে, গাছ না থাকলে আবার তাকে বন বলে নাকি! তেমনটা মনে হলে, একে পাথরের রাজ্য বা পাথরের দেশও বলা যেতে পারে। এর প্রকৃত নাম ‘স্টোন ফরেস্ট’, বাংলায় যাকে বলে পাথরের বন।
বিস্ময়কর এ বনটির অবস্থান চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। এখানে সারিবেঁধে গাছের মতোই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য পাথর। আর এ পাথরগুলোকে দেখলে অনেকটা গাছের মতোই মনে হয়। তবে এটা ঠিক যে, গাছের রং সবুজ হয়ে থাকে, কিন্তু পাথরগুলো সবুজ নয়। বরং পাথরগুলোর গায়ে কারুকার্য করা।
দেখে মনে হয়, অনেক স্তম্ভ একসঙ্গে বানিয়ে রাখা হয়েছে। অনেকে মনে করতে পারে, চীনারা বুদ্ধি করে এ সুন্দর পাথরগুলো সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। কিন্তু এ ধারণা করলে ভুল হবে। আসলে এগুলো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে ভূতত্ত্ববিদদের ব্যাখ্যা হচ্ছে পাথরগুলো প্রাচীন আমলের। প্রায় ২৭ কোটি বছর আগের এসব পাথর। তবে সে সময়ে পাথরগুলো এমন কারুকার্য ও আকর্ষণীয় ছিল না। এগুলো তখন সমুদ্রের নিচে ছিল বলে ধারণা করা হয়। সমুদ্রের নিচে ধীরে ধীরে অনেক চুনাপাথর জমতে থাকে। সময়ের অববাহিকায় চুনাপাথরগুলো বড় হতে হতে একসময় উঁচু হতে থাকে। একসময় পাথরে রূপ নেয়। বহু বছর ধরে সমুদ্রের ঢেউ পাথরগুলোর গায়ে এসে আঘাত করত। সেই আঘাতেই এদের গায়ে এমন প্রাকৃতিক নকশা তৈরি হয়েছে। এরপর চীনের এ অঞ্চলে হঠাৎ ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানি কমতে থাকে। এভাবে পানি কমতে কমতে একপর্যায়ে বেরিয়ে আসে বছরের পর বছর ধরে নিজেদের আড়াল করে রাখা পাথরগুলো। তারপর মানুষের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এখন পর্যাপ্ত আনন্দময় সময় কাটাতে এখানে আসে ভ্রমণপিয়াসিরা।
প্রকৃতির আপন খেয়ালে তৈরি হয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যের এ পাথরের বন। বনটি প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে। বনটিতে বিভিন্ন উচ্চতার ও বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য পাথর রয়েছে। পাথরগুলোর অবস্থানের ক্ষেত্রেও বেশ বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। কিছু পাথর আছে চ্যাপ্টা, কিছু গোল, কিছু আবার পশুপাখি বা মানুষের অবয়বের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়।
‘স্টোন ফরেস্ট’ বা পাথরের বন মূলত সাতটি অঞ্চল নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এ সাতটি অঞ্চল হলো লিজিজিং স্টোন ফরেস্ট, নাইগু স্টোন ফরেস্ট, ঝিয়ুন গুহা, চ্যাং হ্রদ, ইউ হ্রদ, ডাডি জলপ্রপাত ও কিফেং গুহা। ২০০৭ সালে ইউনেস্কো এ বনের অংশ ‘নাইগু স্টোন ফরেস্ট’কে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। ইউনেস্কোর কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়া স্টোন ফরেস্টের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই থেকে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসিদের জন্য অন্যতম একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে চীনের এ পাথরের বন।
বনটি দেখতে ধূসর মনে হলেও যখন বৃষ্টি হয়ে পাথরের শরীর ভিজে যায়, তখন পুরো বনে
কালচে-খয়েরি রঙের আভা ছড়িয়ে যায়। এ সময়ে বনটির সৌন্দর্য আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বনটির চারপাশ ঘুরিয়ে দেখানোর জন্যে পর্যটকদের জন্য রয়েছে আধুনিক বৈদ্যুতিক ট্রেনের সুবিধা। তবে চাইলে পাথরগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘোরাঘুরি করা যায় পুরো বনে। এজন্য সঙ্গে থাকতে হবে হাঁটার জন্য সহায়ক জুতা। সঙ্গে ছাতা ও ক্যামেরা রাখতে ভুলবেন না। হেঁটে হেঁটে যদি বনের চারপাশটা ঘোরা যায়, তখনই মূলত বনের সৌন্দর্য ধরা পড়ে হাজার গুণে। এ সময় পাথরগুলোকে জীবন্ত মনে হয়। হাজার হাজার বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এ পাথুরে বন দর্শনার্থীদের চোখে বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এ যেন প্রকৃতির এক আজব লীলা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০