রোহান রাজিব: দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাংকটি লোকসান গুনে আসছে। অবশেষে ৩৫ বছর লোকসানি প্রতিষ্ঠানটিকে মুনাফার ধারায় আনতে লেনদেনে যুক্ত করা হয় প্রযুক্তিনির্ভর সেবা। গ্রাহকরা যাতে মুঠোফোনের মাধ্যমে সেবা পেতে পারেন, সেজন্য চালু করা হয় ‘রাকাব অ্যাপ’। কিন্তু অধিকাংশ গ্রাহক স্মার্টফোন ব্যবহার না করায় এ অ্যাপ তারা কাজে লাগাতে পারেন না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কর্মকর্তারা গ্রাহকদের ব্যাংক হিসাবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাকাব অ্যাপসে হিসাব খুলে গ্রাহকের অর্থ তুলে নিচ্ছেন। এরই মধ্যে এ ধরনের বেশকিছু অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে একাধিক কর্মকর্তাকে। আর বহিষ্কৃত কর্মকর্তাদের বাঁচাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত পাঁচ কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক রাকাবের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. রইছউল আলম মণ্ডল চলতি বছরের গোড়ার দিকে ব্যাংকসেবা আধুনিকায়নের জন্য একটি ‘মোবাইল অ্যাপ’ তৈরির নির্দেশনা দেন। সে মোতাবেক ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মান্নানের (বর্তমান বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) নির্দেশনায় ‘রাকাব অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের শাখাগুলোয় প্রতিদিন একজন কর্মকর্তাকে কমপক্ষে ১৫টি হিসাব অ্যাপে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু রাকাবের অধিকাংশ গ্রাহক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক। তাদের অনেকে প্রযুক্তি-অসচেতন ও অক্ষরজ্ঞানহীন। ফলে তারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারেন না। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের ব্যাংক হিসাবের তথ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিজেদের স্মার্টফোনের মাধ্যমে রাকাব অ্যাপে গ্রাহকদের হিসাব খুলে দিয়ে নিজেদের ওপর অর্পিত দৈনিক ১৫টি কোটা পূরণ করেন। এতে করে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার হাতে। এমন পরিস্থিতিতে বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তা গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রাকাবের অনন্ত ১২টি শাখার কর্মকর্তারা এভাবে অ্যাপস জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জানা গেছে।
রাকাবের প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জয়পুরহাটের দোগাছী শাখার সিসি ঋণ গ্রহীতা ছিলেন সাইদুর রহমান। বেশ কিছুদিন আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। নিয়মানুযায়ী, ওই হিসাবের বৈধ দাবিদার হিসাবটির নমিনি সাইদুর রহমানের ছেলে। কিন্তু ওই মৃত গ্রাহকের ছেলের ভুয়া নমুনা স্বাক্ষর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর জালিয়াতি করে চলতি বছরের মে মাসে অ্যাপসের মাধ্যমে আরটিজিএস পদ্ধতিতে ওই হিসাব থেকে অর্থ অপসারণ করা হয়েছে। এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শাখায় ওই সময়ে দায়িত্ব পালনকারী ব্যবস্থাপক (মুখ্য কর্মকর্তা) মেহেদী হাসান। তিনি ওই মৃত গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে ১৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন বলে প্রমাণ মিলেছে। তিনি শাখাটির দ্বিতীয় কর্মকর্তা রূপা দত্তের ইউজার আইডি ব্যবহার করে এ অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
একইভাবে শাখাটির ঋণগ্রহীতা মো. নজরুল ইসলামের হিসাব থেকে ১৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। নজরুল ইসলাম পুরো ঋণ পরিশোধ করার পরও তার হিসাব বন্ধ না
করে এ জালিয়াতি করা হয়। এটিও অ্যাপ থেকে ভুয়া আরটিজিএসের মাধ্যমে করা হয়। এখানে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা আল-ইমরানের ইউজার আইডি ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া শাখাটির আইও রশিদের মাধ্যমে ঋণের টাকা আদায় করে তা ব্যাংকে জমা না দিয়ে পকেট
ব্যাংকিং করে ২৯ লাখ ১১ হাজার ৩০০ টাকা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার ৩৬ হাজার ৬০০ টাকা, দোগাছী শাখার গ্রাহক জুলফিকার আলীর তিন লাখ ২০ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ৭৪ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, কেবল মেহেদী হাসানই এমন ঘটনা ঘটাননি, বরং ব্যাংকের আরও কয়েকটি শাখায় এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অ্যাপ জালিয়াতির এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন কুড়িগ্রামে খড়িবাড়ীবাজার শাখার দ্বিতীয় কর্মকর্তা রায়হান হাবিব। অ্যাপসের মাধ্যমে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম করার অভিযোগে তাকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
এছাড়া নাটরের বাগাতিপাড়া শাখা, আব্দুলপুর শাখা, আহমেদ নগর শাখা ও প্রধান শাখায় গ্রাহকের ব্যাংক হিসেবের বিপরীতে অ্যাপসের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলে দেন শাখার কর্মকর্তারা। এভাবে সেখানেও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সাবেক তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মান্নানের কাছে বাহবা পাওয়ার লক্ষ্যে নাটোরের সাবেক জোনাল ব্যবস্থাপক রেজাউল ইসলাম শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে এমন অনৈতিক কাজ করিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকটির শতাধিক শাখায় এমন কর্মকাণ্ড ঘটেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের রক্ষা করার জন্য রাকাবের প্রধান কার্যলয়ের পাঁচ কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তৎপরতা চালাচ্ছেন। এসব কর্মকর্তা হলেন প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) শকওত শহীদুল ইসলাম, কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাক সরোয়ার হোসেন, সাধারণ সেবা বিভাগের ডিজিএম মিজানুর রহমান, চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব (পিএস) মুকুল বর্ধন ও আইটি বিভাগের ডিজিএম আবুল কালাম।
এসব বিষয়ে জানার জন্য রাকাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহিদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ফোন রেখে দেন এবং পরে যোগাযোগ করার কথা বলেন। এরপর একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ দেয়া হলেও সিন করে কোনো উত্তর দেননি।
পরে ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আইটি বিভাগের ডিজিএম আবুল কালামের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইটি বিভাগের ডিজিএম আবুল কালাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ ঘটনায় যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ শাস্তি দিয়েছে। ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
তার নিজের বিরুদ্ধেও জালিয়াতিতে জড়িতদের রক্ষা করার জন্য তদবির করার অভিযোগ রয়েছে বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি কাউকে চিনি না।’
উল্লেখ্য, যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে রাকাবও ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা দিতে চলতি বছরের মার্চ মাসে রাকাব অ্যাপস সেবা চালু করে। একে একে অনলাইন ব্যাংকিং (সিবিএস), আরটিজিএস, বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার ও স্বয়ংক্রিয় চালান প্রক্রিয়া (এ-চালান) চালু করেছে ব্যাংকটি। এবার পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমই হাতের মুঠোয় নিয়ে আসছে ব্যাংকটি। তবে এখন ব্যাংকটি অ্যাপস সেবা দেয়ার নামে জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটাচ্ছে।