নাজমুল হুসাইন: রামপুরার একটি সুপারশপে গতকাল প্রতি হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছিল মাত্র ২০ টাকা দরে। যদিও কয়েক মাস আগেই এসব সুপারশপে ডিমের হালি ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। খোলা বাজারেও ২০-২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ফার্মের ডিম। অর্থাৎ কিছু দিনের ব্যবধানেই প্রতি হালিতে ডিমের দাম কমেছে ১২ থেকে ১৪ টাকা।
রাজধানীর পাইকারি ডিমের আড়তে খোঁজ নিয়েও মিললো এমনই তথ্য। পবিত্র রমজান ও প্রচণ্ড গরমে ডিমের চাহিদা একেবারেই তলানিতে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যটির সরবরাহ বেশ বেড়েছে। এতে ডিমের দামের এমন নি¤œমুখী অবস্থায় বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। এখন রাজধানীতে প্রতি হালি ডিম খুচরায় মিলছে ২০ থেকে ২৪ টাকার মধ্যে। এতে লোকসানের মুখে পড়ছেন খামারিরা।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে কয়েক রকমের ডিম রয়েছে। যার মধ্যে ফার্মের মুরগির ডিমের মাধ্যমেই এখন চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ পূরণ হয়। রঙ ও আকারভেদে এসব ডিমের দামে কিছু ফারাক আছে। তবে সব ধরনের ফার্মের মুরগির ডিমের দাম বিগত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বনি¤œ। যার প্রভাবে দেশি মুরগি ও হাঁসের ডিমের দামও কমেছে।
তারা জানান, ফার্মের সাদা ডিমের বর্তমান বাজার মূল্য লাল ডিমের তুলনায় কম। প্রতি একশো (১০০ পিস) সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। একইভাবে লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকায়, যা গত তিন দিন আগে আরও প্রায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা কম ছিল। এখন দাম ওঠানামার মধ্যে আছে।
সরেজমিন আড়ত ও কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেল, পাইকারি আড়তগুলোয় প্রচুর ডিম রয়েছে। এখানে-সেখানে ডিমের বড় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে খুচরা ক্রেতার। তবে বাজারে ক্রেতাই তুলনামুলক কম। এদিকে সরবরাহ বেশি থাকায় রাজধানীর অনেক স্থানে ভ্রাম্যমাণ খুচরা ডিম বিক্রেতারা কম দামে ডিম বিক্রি করছে। ছোট বাজারগুলোতেও ডিমের সরবরাহ বেশি, দাম কম।
এমন পরিস্থিতির সম্পর্কে জানতে চাইলে তেজগাঁও ডিমের আড়ত মালিক সমিতির উপদেষ্টা ও খামার মালিক মাসুম খান শেয়ার বিজকে বলেন, চলতি মাসের শুরুতে আড়তে লাল ১০০ ডিমের দাম ছিল ৭৪০ টাকা। এরপর তা কমতে কমতে ৬৪০ টাকায় নেমেছিল। কিন্তু হঠাৎ প্রায় এক মাস ধরে ডিমের দাম এত কমেছে যে, তা কয়েক বছরের মধ্যে সব থেকে কম।
তিনি বলেন, রোজা ও প্রচণ্ড গরমের কারণে ডিমের চাহিদা কম। কিন্তু সরবরাহ বেশ বেড়েছে। এতেই দাম পড়ে গেছে। কিছুদিন আগে ডিমের শ ৪০০ টাকায় নেমেছিল। গত দুদিন আবার একটু বেড়েছে। দাম ওঠানামার মধ্যে রয়েছে।
ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মোহাম্মদ হানিফ বলেন, প্রতি বছর উৎপাদন বাড়ছে কিন্তু ভোগের পরিমাণ তো প্রায় একই রয়েছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় বাড়তি ডিম বাজারকে পড়তির দিকে নিয়েছে। বেশ কিছুদিন সেই পড়তি দাম স্থিতিশীল হয়ে গেছে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় জোগান অনেক বেশি।
রাজধানীর বেশিরভাগ ডিম আসে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নরসিংদী জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে। কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন ৭০টি আড়তে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৮০ থেকে ৯০ লাখ ডিম আসে। এসব ডিমের বেশিরভাগ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহের পাশাপাশি ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায়ও সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ দেশের ডিমের সর্ববৃহৎ কারবারি এখানেই।
এদিকে ডিমের চাহিদা না থাকায় দারুণ লোকসানে পড়েছেন খামারিরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুরগির খামারে একটি ডিম উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা। খামার থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেই ডিম কিনছেন সাড়ে ৩ থেকে ৪ টাকায়। এতে ডিমপ্রতি একজন খামারির লোকসান গুনতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই টাকা। ফলে বিপাকে পড়েছেন পোলট্রি খামারিরা। চার-পাঁচ মাস আগেও খামারে প্রতি পিস ডিম ৫ থেকে ৬ টাকা বিক্রি হতো। কিন্তু গত কয়েক মাসে ক্রমাগত ডিমের দাম কমায় এখন তাদের এ লোকসান গুনতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর খামার মালিক হাসিবুর রহমান বলেন, এখন ডিম বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায়, সেই টাকা দিয়ে মুরগির খাবারই পুরোপুরি কেনা যাচ্ছে না। প্রতিদিন ডিম বিক্রি হলেও প্রতিটি ডিমে দেড় থেকে দুই টাকা লোকসান হচ্ছে। এমন অবস্থায় পথে বসা ছাড়া উপায় নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রতি বছর ডিমের উৎপাদন বাড়লেও সেই তুলনায় চাহিদা বৃদ্ধি পায়নি। এতে কোনো সময় ডিমের ভোগ কমে গেলে তার প্রভাব পড়ে বাজারে। অনেক সময়ই রমজান ও প্রচুর গরমে এমন অবস্থা হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যে, প্রতি বছর দেশে বাড়ছে ডিমের উৎপাদন। শেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ২০৯ কোটি ৪১ লাখ, উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ১৯১ কোটি ২৩ লাখ। অর্জিত সাফল্য ৯৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর তা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৯১ কোটি ৭১ লাখ পিস বেশি হয়েছে।
এ অবস্থায় গত কয়েক মাসে ডিমের দাম কমে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছেন খামারিরা। গত মাসে গাজীপুরের শ্রীপুরে কাফনের কাপড় পরে পোলট্রি ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ করেছেন। সঙ্গে প্রচুর ডিম রাস্তায় ভেঙে ফেলে প্রতিবাদ জানানো হয়। সে সময় তারা মুরগির বাচ্চা, পোলট্রি খাবার ও ওষুধের দাম হ্রাস, সহজ উপায়ে ভ্যাকসিন সরবরাহ এবং বহুজাতিক কোম্পানির ডিম ও মাংস উৎপাদন বন্ধের দাবি জানানো হয়।
Add Comment