নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপির শনিবারের সমাবেশ ঘিরে রাজধানীতে রাজনৈতিক উত্তাপ শুরু হয়েছে। গত বুধবার বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর প্রভাব পড়েছে শেষ কর্মদিবসে ব্যাংকগুলোয়। রাজধানীর ব্যাংকপাড়া মতিঝিল, নয়াপল্টন ও ফকিরাপুল এরিয়ায় অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক কম ছিল গ্রাহক। গ্রাহক কম থাকার কারণে লেনদেন কম হয়েছে। গতকাল এসব এলাকার বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা ঘুরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা যায়।
এসব এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই নয়াপল্টন এলাকায় বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা প্রায় শূন্য ছিল। বুধবার পুলিশ-বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গ্রাহকরা ওইসব এলাকা এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন নয়াপল্টনের ব্যাংক কর্মকর্তারা।
সিটি ব্যাংক নয়াপল্টন শাখার এক কর্মকর্তা জানান, আজকে অন্যদিনের তুলনায় তেমন কোনো গ্রাহক ছিল না। অন্যান্য সপ্তাহ শেষ কর্মদিবসে যেমন গ্রাহকের চাপ থাকে, আজ একদমই ছিল না। তাই লেনদেন কম হয়েছে। তিনি আরও জানান, পুলিশ ওই এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকায় গ্রাহকরা নয়াপল্টন এলাকায় আসেননি।
গতকাল নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত রাস্তা পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সড়কের ভেতরে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি। এসব এলাকার ব্যাংক শাখাগুলোয় মানুষের আসার চিত্র তেমন দেখা যায়নি। একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, মূল সড়ক ও গলি রাস্তা বন্ধ থাকায় সকালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই সময়মতো ব্যাংকে আসতে পারেননি। তারা নিজেরাও আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
অন্যদিকে মতিঝিল এলাকার ব্যাংক শাখাগুলোয় দেখা গেছে কম ব্যাংকিং লেনদেন। দুপুর মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে গিয়ে দেখা যায়, এ শাখায় অন্য দিনের তুলনায় অনেক গ্রাহক কম এসেছে। যারা এসেছে সবাই অতিপ্রয়োজনে। তবে সবার মনে আতঙ্ক ছিল বলে এসব গ্রাহকরা জানান। এ শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, আজ ব্যাংকের লেনদেন একদমই কম। হাতেগোনা কয়েক গ্রাহক এসেছেন। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে এমন চিত্র খুব কমই দেখা যায় বলে জানান তিনি।
অগ্রণী ব্যাংক মতিঝিল শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক টানাপোড়নের কারণে কমসংখ্যক গ্রাহক শাখায় আসেন। বৃহস্পতিবার আমাদের শাখায় ব্যাংকিং লেনদেন কম ছিল।
নয়াপল্টনে আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের ভিআইপি রোড শাখা থেকে টাকা তুলতে আসেন ব্যাংকটির গ্রাহক বকুল আহমেদ। তিনি বলেন, আমি পোশাকের ব্যবসা করি। তাই নিয়মিতই এ শাখায় আসতে হয়। অন্যান্য দিন লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাংকের কাজ করতে হতো। আজ মাত্র দু-তিনজন গ্রাহক ছিলেন ব্যাংকে।
ঢাকা ব্যাংকে আসা একজন গ্রাহক বলেন, চীনের সাংহাই বন্দরে আমাদের পণ্য আছে। এখান থেকে এনওসি পাঠাতে না পারলে দু-তিন দিনের জন্য পণ্য বন্দরে আটকে থাকবে। এ জন্য ঝুঁকি আছে জেনেও নথিপত্র সংগ্রহ করতে আজকে ব্যাংকে এসেছি। আসার সময় পথে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা পথ আটকেছিলেন। পরে ব্যাংকে জরুরি কাজ আছে বলার পর আসতে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিএনপি নেতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে আতঙ্কিত হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি থেকে বের হননি। তাই ব্যাংক লেনদেনে একটা প্রভাব পড়েছে। আগের সময়ের চেয়ে শেষ কর্মদিবসে লেনদেন কম হয়েছে।
এদিকে, একই ঘটনার কারণে এসব এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে সরাসরি প্রভাব পড়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে নয়াপল্টন হয়ে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে পুলিশ। পলওয়েল মার্কেট, গাজী ভবন শপিং সেন্টার, সিটি হার্ট, পাইকারি মার্কেট পল্টন চায়না টাউনসহ এ সড়কের দুই পাশের সব বিপণিবিতান, বিক্রয়কেন্দ্র, দোকানপাট ও রেস্তোরাঁ বন্ধ। এ ছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে বের হয়েছেন, এমন লোকজন ছাড়া সড়কটিতে কাউকে যেতে দিচ্ছে না পুলিশ।
ওই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্র, পোশাকের পাইকারি বাজার, প্রবাসী শ্রমিক পাঠানোর কোম্পানি, রেস্তোরাঁসহ বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রাস্তা বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পুলিশ তাদের আজ প্রতিষ্ঠান খুলতে নিষেধ করেছেন। সাধারণত মাসের শুরুর দিকে বেচাকেনা ভালো হয়। কিন্তু বিএনপির সমাবেশ নিয়ে উত্তেজনা ও পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে গত কয়েক দিনে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ প্রভাব পড়েছে। বেচাকেনা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।
নয়াপল্টনে ব্যক্তিগত গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্র চেরি অটোসের স্বত্বাধিকারী বলেন, ‘৫ তারিখের পর থেকে গ্রাহকের উপস্থিতি কমে গেছে। ব্যবসায়ী, ক্রেতাÑসবাই আতঙ্কে আছেন।’ আজ ভোরে বিক্রয়কেন্দ্র খুলতে এলে পুলিশ বলেছে, ‘এ এলাকায় নিরাপত্তার অভাব আছে। আপনারা দোকান খুইলেন না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার একটি মিষ্টির দোকানের মালিক বলেন, ‘বুধবার সংঘর্ষ শুরু হলে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে চলে যাই। আজ সকালে আমি দোকানে আসতে চাইলেও পুলিশ দেয়নি। দোকানে আমার প্রায় ৪৫ হাজার টাকার মিষ্টি আছে। এগুলো সরিয়ে নিতে না পারলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাবে।’
উল্লেখ্য, গত বুধবার বিএনপির ১০ ডিসেম্বরকে সমাবেশকে ঘিরে কেন্দ্রীয় কার্যালয় এরিয়ায় নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। সঙ্গে একজন নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।