মো. তৌহিদুজ্জামান বাবু: বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা। উন্নয়নের কাজ হচ্ছে অনেক, কিন্তু প্রায় দুই কোটি ১৭ লাখ মানুষের বসবাস করার জন্য উপযোগী শহর হিসেবে গড়ে উঠছে কি না, সেটাই ভাবার প্রথম বিষয়। এখনও পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে এই মসজিদের শহর ঢাকা। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে; তবে সর্বপ্রথম যে কারণটির কথা না বললেই নয়, তা হচ্ছে অসহনীয় যানজট। অনেক সময় দেখা যায় ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হয় দু-তিন ঘণ্টায়। মানুষের কাজের সময়ের একটা বড় অংশ অপচয় হয় এই যানজটের মাধ্যমে। শুধু সময়ের অপচয় ঘটে তা কিন্তু নয়, অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ। সময় ও অর্থের ক্ষতিসাধন করেই থেমে থাকে তা কিন্তু নয়, বরং অনেকের প্রাণ কেড়ে নিতেও দ্বিধা বোধ করে না এই যানজট। কেননা অনেক সময় মুমূর্ষু রোগী হাসপাতালে নিতে গিয়ে যানজটে আটকে থেকে রাস্তায় মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায় অহরহ মানুষকে। বছরের পর বছর এই সমস্যা মূলোৎপাটনের জন্য অনেক কথা হয়েছে, নেয়া হয়েছে অনেক পরিকল্পনাও, কিন্তু অবস্থার তেমন কোনো অদল-বদল হয়নি। বরং কোনো কোনো রাস্তায় যানজটের পরিমাণ হয়ে উঠেছে আরও তীব্রতর।
তবে এ যানজটের কারণ হিসেবে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক কথাই বলেছেন এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পাওয়াটাকেই আসল কারণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা এখনও ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে তিন শতাধিক গাড়ির নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে, যার বেশিরভাগই হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে যতগুলো ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে তার মধ্যে ৭৮ শতাংশ চলে ঢাকার রাস্তায়। জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে হারে বাড়ছে না গণপরিবহন কিংবা ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। অথচ অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছোট ছোট গাড়ি বা ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য ঢাকার রাস্তায় বাড়ছে যানজট। তবে সব ধরনের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মূলকেন্দ্র এখনও ঢাকা। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়। তাই সব মানুষই এসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় পাড়ি জমায় ঢাকার পথে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পোহাতে হয় অনেক দুর্ভোগ।
পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন নগরীর স্থিতিশীলতা, অপরাধের মাত্রা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ও মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর ভিত্তি করে উন্নত এবং অনুন্নত নগরীর মান নির্ধারণ করা হয়। সেই মানের ভিত্তিতে এরই মধ্যে যানজটের নগরী এবং বসবাসের অনুপযোগী হিসেবে দুর্নাম কিনেছে রিকশার শহর ঢাকা।
কোনো শহর বসবাসের উপযুক্ত কি না, তা বিবেচনার প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে পরিবেশ। ঢাকা শহরের পরিবেশ কেমন, তা বলতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে পরিবেশ আদৌ আছে কি না?
কেননা এই শহরে প্রতিদিন পাঁচ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি ময়লা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি থেকে বের হলেই দেখা যায় রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। কলার খোসা, কাগজ, প্লাস্টিকের ব্যাগ অথবা বোতল দেখা যাবে না, ঢাকায় এমন রাস্তা বা পাড়া খুব কমই আছে। চলার পথে খোলা কনটেইনারের উপচে পড়া আবর্জনাকে নাকে হাত দিয়ে পাশ কাটানো অথবা ময়লা বহনকারী ট্রাক থেকে কিছু উড়ে এসে গায়ে পড়বে কি না, সেই উদ্বেগ নিয়েই রাস্তা চলতে হয় বহু পথচারীকে। আর বিভিন্ন অলি-গলি কিংবা মোড়ে গড়ে ওঠা আবর্জনার স্তূপ থেকে ছড়িয়ে পড়ে প্রকট দুর্গন্ধ, যা বিশুদ্ধ বাতাসের সঙ্গে মিশে বিষাক্ত বায়ু তৈরির মাধ্যমে পরিবেশ ও বায়ু উভয়ই দূষিত করে ফেলে।
প্রায় এক হাজার ৪৬৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই মহানগরীতে জনসংখ্যা এখন দুই কোটি ১৭ লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ঢাকা শহরে গড়ে উঠেছে বস্তি, যার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক। সরকারি-বেসরকারি জরিপ থেকে জানা যায়, বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এদের সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফুটপাতের হকার, ভ্রাম্যমাণ হকার, দিনমজুর ও বিভিন্ন পেশায় যুক্ত শ্রমিক এবং এদের অধিকাংশই সপরিবারে বস্তির একটি ঘরে থাকে। বস্তির পরিবেশ কেমন তা সবারই জানা। সেখানে নেই কোনো সুপেয় পানি কিংবা স্যানিটেশনের ব্যবস্থা, এমনকি বাতাস চলাচলের সুযোগও নেই সেখানে। এভাবেই ৪০ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করে ঢাকার বস্তিগুলোয়। অস্বাস্থ্যকর বস্তিগুলো পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।
পরিবেশ প্রসঙ্গে বলতে গেলে বায়ুদূষণের কথা বলতেই হয়। ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে মনে হয় এখানে অক্সিজেনের পরিমাণ একদম শূন্যের কাছাকাছি। বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ। পরিবেশমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন একটি বার্তা সংস্থার কাছে স্বীকার করেছেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প থেকে নির্গত ধুলাবালি, ফিটনেসবিহীন মোটরগাড়ি ও বাস-ট্রাকের ধোঁয়া এবং ঢাকা শহরের আশপাশের ইটভাটাকে, যেখান থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া শহরের ওপর ভেসে আসে। ফলে বিশুদ্ধ বাতাস কমে যায় দিনের পর দিন।
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগা সিটি। ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে, ফলে শহরটি তাদের অভ্যন্তরীণ সংস্থান এবং ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাগরিক সুবিধা মোকাবিলা করতে পারছে না। আর অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা শহরে তিল পরিমাণ স্থান খুঁজে পাওয়া হয়ে পড়েছে দুষ্কর। শহরের বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারিত্ব বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। লেক ও নদীর পাড়গুলো দখল করে নিচ্ছে কিছু অসাধু লোক, যার ফলে নদী হারাচ্ছে নাব্য, লেক হচ্ছে দূষিত এবং ঢাকা শহরে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতার মতো বড় ধরনের সমস্যা। অপর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, স্বল্প ধারণক্ষমতা ও অগভীর সেকেলে ড্রেন ব্যবস্থা, খোলামেলা বা ত্রুটিপূর্ণ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যমান পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব কিংবা বর্জ্যরে স্তূপ অপসারণ না করা প্রভৃতি জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী। এছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্নয়হীনতা যেন সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই জলাবদ্ধতার কারণেও জনসাধারণ আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া কিংবা চিকুনগুনিয়ার মতো মারাত্মক রোগে।
ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, রাজধানীতে বর্তমানে যে ড্রেন রয়েছে, সেগুলো ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ মিলিলিটার পর্যন্ত বৃষ্টির পানি নির্গমনের ক্ষমতা রাখে। ফলে এর বেশি বৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা ও জলজট। যদিও নগরবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় উন্নতি করলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না, বরং কালবিলম্ব না করে সমস্ত খাল অবৈধ দখলকারীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং এগুলোর সংযোগ আবার প্রতিস্থাপন করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর পাশাপাশি জলাবদ্ধতা মোকাবিলার জন্য জনসেবা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমন্বয় এবং জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে।
শুধু যানজট, পরিবেশ দূষণ, জলাবদ্ধতা কিংবা বায়ুদূষণেই প্রতিবন্ধকতাগুলো সীমাবদ্ধ নয়, বরং সাধারণ মানুষ চলাচলের জন্য তৈরিকৃত ফুটপাত রক্ষাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর ফুটপাত পথচারীদের নাকি হকারদের, তা বোঝা মুশকিল। প্রায় সব ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত এখন হকারদের দখলে। ভ্রাম্যমাণ ও অস্থায়ী হকারদের কারবারে ফুটপাত ধরে হাঁটতে বেগ পেতে হয় পথচারীদের। অর্থাৎ ফুটপাতই এখন যেন পথচারীদের ভোগান্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একদিকে বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ, অন্যদিকে হাজারো প্রতিবন্ধকতার ফলে পরিবেশবান্ধব রাজধানী গড়ে তোলার স্বপ্ন আজ অবধি রয়েছে অপূর্ণ। কেননা দিন দিন নগরীর পরিধি বাড়লেও পরিকল্পনার অভাব এখনও প্রকটভাবে দৃশ্যমান। যেমন আবাসিক এলাকাগুলোতেই অবাধে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। ফলে নগরবাসী হয়ে পড়ছে অনেক অসহায় এবং বসবাস করছে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। এ ছাড়া যে-ই প্রকৃতির ছোঁয়ায় মানুষের জীবনের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে মানুষকে দিতে পারে অনাবিল আনন্দ ও স্বস্তি, সেই প্রকৃতিরই অভাব যেন রাজধানীতে প্রকট হয়ে পড়ছে দিনের পর দিন। এখানে শিশুদের বিকাশ সাধনে সহায়ক প্রয়োজনীয় শিশুপার্ক, খেলার মাঠ ও বিনোদনকেন্দ্র যেমন অপর্যাপ্ত, তেমনি গাছপালার পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপকহারে। আর অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও মানুষের লোভে পুড়ে নিঃশেষ হতে চলেছে রাজধানীবাসীর স্বপ্ন। এ অবস্থার অবসানে ঢাকাকে মানুষের বসবাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করাই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঢাকার নাগরিক নিরাপত্তার দিকে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি বাড়াতে হবে জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা। তাই রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে হলে যেমন প্রথমত গণপরিবহন বৃদ্ধি করতে হবে, বিপরীত দিকে কমিয়ে দিতে হবে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার, তেমনি দ্বিতীয়ত পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে হলে সবাইকে হতে হবে দায়িত্বশীল। সুতরাং বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তুলতে শুধু সরকার নয়, প্রয়োজন সবার আন্তরিকতা ও জনসচেতনতা।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়