নিজস্ব প্রতিবেদক :কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর গরুর হাটগুলোয় ক্রেতার অপেক্ষায় রয়েছেন বিক্রেতারা। আফতাবনগরের লোহার ব্রিজ থেকে বটতলা হয়ে তালতলা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই হাটের অবস্থান। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্রির জন্য কোরবানির পশু নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া এখনও পর্যায়ক্রমে পশু নিয়ে হাটে আসছেন তারা। এদিকে ঈদ ঘনিয়ে এলেও পুরোপুরি জমে ওঠেনি এখানকার হাট।
গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড্ডা থেকে রামপুরা ব্রিজের উত্তরে সড়কে পূর্ব পাশে আফতাবনগরে প্রবেশের পথ। সেখানে বড় করে টানানো আছে হাটের তোরণ। তাতে লেখাÑ ‘বিরাট গরু-ছাগলের হাট’। কিছু সময় পরপরই তোরণের নিচ দিয়ে হাটে ঢুকছে ট্রাকভর্তি গরু।
এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পেরিয়ে দেখা মিলল হাটের প্রথম অংশ। হাটের এই অংশে এখনও বেশিরভাগ জায়গা ফাঁকা। এখানে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ করছেন হাট কমিটির লোকজন। পুরো সড়কে লাগানো হয়েছে বৈদ্যুতিক বাতি। একটু এগিয়ে বটতলায় কোরবানির পশুর হাট। এখানে গরু রাখার জন্য জায়গা তৈরি করছেন অনেক ব্যবসায়ী। পশুগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখতে নিচু জায়গায় মাটি ভরাট করে বাঁধা হয়েছে বাঁশের খুঁটি। এছাড়া আগেভাগে জায়গা দখল করে বড় ঘর বানাতে দেখা গেছে খামারিদের।
মূলত হাট এলাকার প্রায় ৬০ শতাংশ অংশজুড়ে কোরবানির পশু নিয়ে ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এখনও তেমন ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না তারা। তাদের মতে, গত বছরের তুলনায় এবার হাটে পশুর সংখ্যা কম মনে হয়েছে। হয়তো দুই-তিন দিনের মধ্যে হাট জমে উঠবে।
হাটে এখন পর্যন্ত যারা এসেছেন, তাদের বেশিরভাগ পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও যশোর এলাকার ব্যবসায়ী। তাদের কেউ কেউ সময়মতো গরুকে গোসল করাচ্ছেন ও খাবার দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের জন্য খাবার রান্নার কাজটিও করছেন। কেউ গরুর সঙ্গে ঘুমিয়ে গেছেন, আবার কেউ মেতে উঠেছেন তাস খেলায়। তবে হাটে তেমন কোনো ক্রেতাকে চোখে পড়েনি এই প্রতিবেদকের। কেউ পশুর দাম জানতে চাচ্ছিলেন মাত্র।
সোমবার কুষ্টিয়া থেকে ১৩টি গরু নিয়ে আফতাবনগর হাটে এসেছেন ব্যবসায়ী আনিসুর। তিনি বলেন, আমার কাছে থাকা সব গরুর দামই দুই লাখ টাকার বেশি। এখন পর্যন্ত দুটি গরু বিক্রি করেছি। এখন অতটা ক্রেতা নেই। যারা আসেন তারা এক লাখ ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ৮০ টাকা দাম বলেন। ঈদের দু-তিন দিন আগে হয়তো ভালো বিক্রি হবে। আর বিক্রি হোক বা না হোক, ঈদের আগের রাতে বাড়ি চলে যাব।
নাটোর থেকে ১৩টি গরু নিয়ে এসেছেন মোক্তার হোসেন। এ বছর বিক্রির জন্য নিজ হাতে গরুগুলো লালন-পালন করেছেন তিনি। তিনি বলেন, আমার কাছে থাকা গরুগুলোর মধ্যে সর্বনি¤œ দাম এক লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ দাম চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। ক্রেতারা এক লাখ ৪০ হাজার থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকাচ্ছে। তবে এখনও দামে পোষায়নি বলে একটি গরুও বিক্রি করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, আমি গত বছরও এখানে হাট করেছি। সে তুলনায় এবার গরুর সংখ্যা কম মনে হয়েছে। আশা করি কয়েক দিনের মধ্যে সব জায়গা কোরবানির পশুতে ভরে যাবে।
এদিকে হাটকে কেন্দ্র করে লোহার ব্রিজ থেকে তালতলা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। রাস্তার পাশের খালি জায়গায় ভাতের হোটেল বসিয়েছেন ছোট ছোট দোকানিরা। কেউ আবার ভাজাপোড়ার দোকান বসিয়েছেন, কেউ শরবতের, কেউবা চায়ের।
এদিকে কমলাপুরে বসেছে অস্থায়ী পশুর হাট। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশ থেকে শুরু করে দেওয়ানবাগ শরীফ হয়ে গোপীবাগের কিছু এলাকাজুড়ে এই হাটের অবস্থান। হাটে প্রবেশের প্রধান ফটক রাখা হয়েছে কমলাপুর ও মুগদার সংযোগ সড়কে। হাট পুরোপুরি প্রস্তুত না হলেও এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্রির জন্য কোরবানির পশু নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। হাট পুরোদমে জমে না ওঠায় অনেকেই পর্যায়ক্রমে পশু আনার পরিকল্পনা করেছেন।
গতকাল দুপুরে কমলাপুর হাটের বিভিন্ন অংশ ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ঈদের দু-এক দিন আগে পুরোদমে কোরবানির পশু বিক্রি হবে। তবে এর আগেও কম-বেশি বিক্রি হবে।
ঝিনাইদহ থেকে ১০টি গরু বিক্রি করতে হাটে এসেছেন পান্না মিয়া। তিনি বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাতে গরু নিয়ে এসেছি। সকাল থেকে কয়েকজন ক্রেতা এসেছেন। অবশ্য দাম জিজ্ঞাসা করেই তারা চলে যাচ্ছেন। অনেকে শুধুই দেখতে আসেন। এ বছর গরুর দাম বেশি হওয়াতে অনেকেই বাজার যাচাই করে গরু কিনবেন।
পান্না বলেন, যার আয় যেমন তিনি তেমন গরু কিনবেন। কিন্তু এখন তো মানুষের আয় কম। তাই গরু কিনতেও হিমশিম খাবে অনেকে। যেহেতু এখনও বিক্রি শুরু হয়নি, সেহেতু পরিস্থিতি এখনও বোঝা যাচ্ছে না। পুরোদমে বিক্রি শুরু হলে কেমন গরুতে ক্রেতাদের চাহিদা বেশি সেটা বোঝা যাবে।
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু থেকে বড় দুটি গরু বিক্রি করতে কমলাপুর হাটে এসেছেন ইমরান আলী। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি দুটা বড় গরু এনেছি। এর মাঝে একটি সাড়ে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি হতে পারে। অনেক ক্রেতা গরুগুলো দেখছে। তবে দরদাম করে চলে যাচ্ছে।
ইমরান বলেন, হলু নামের এই গরুটির ওজন হবে প্রায় ১২ মণের বেশি। গরুটিকে সাধারণত খুদ, ভুসি, গম ও ভাতের জাউ খাওয়ানো হয়েছে। গরুটির বয়স প্রায় সাড়ে তিন বছর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা মোশারফ মিয়া বলেন, মানুষজন এখনও গরু কিনছে না। সবাই দেখে আর চলে যায়। এত আগে অবশ্য গরু বিক্রিও হয় না। আমি পাঁচটি গাড়িতে ১২৫টি মাঝারি সাইজের গরু নিয়ে এসেছি। প্রতি বছর এই হাটেই আসি। আগে থেকেই দেখে আসছি মানুষের মাঝারি সাইজের গরুর প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে।
এদিকে সিরাজগঞ্জে ভাই ভাই অ্যাগ্রোফার্ম থেকে ৩৫টি গরু এনেছেন মো. নুর ইসলাম। তিনি বলেন, আমি সবসময় বড় গরু নিয়ে আসি। আমার প্রতিটি গরু পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে আশা করছি। চার বছর ধরে এই হাটেই আসছি। প্রতি বছরই আমি বড় গরু নিয়ে আসি।
কোরবানির গরু কিনতে আসা ইয়াহিয়া ইসলাম বলেন, এ বছর পশুর দাম অনেক। নির্ধারিত বাজেট নিয়ে হাটে এলেও কেনা সম্ভব হচ্ছে না। গতবার যে গরু এক লাখ টাকায় কিনেছি, এ বছর সেই ধরনের গরু প্রায় ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত দাম চাচ্ছে।
তিনি বলেন, হাটে অনেকক্ষণ ঘুরলাম। দেখি সুবিধাজনক মনে হলে একটি গরু কিনে ফেলব।
এদিকে হাটের প্রধান প্রবেশপথে হাসিল দেয়ার কাউন্টার বসানো হয়েছে। এছাড়া কমলাপুরের উট খামারের আগে দেওয়ানবাগ শরীফের সামনে ও গোপীবাগের প্রবেশপথেও হাসিল সংগ্রহের কাউন্টার তৈরি করা হয়েছে। হাট পুরোদমে শুরু হলে কাউন্টারের সংখ্যা বেড়ে ২৫টি থেকে ৩০টিতে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাট পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক সিরাজ হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, পশু আসতে শুরু করেছে। ঈদের আগের তিন-চার দিন বিক্রি বেশি পরিমাণে হবে। এ বছর ২০-২৫টি স্থায়ী হাসিল কাউন্টার ও পাঁচ-সাতটি অস্থায়ী হাসিল কাউন্টার থাকবে। সবমিলিয়ে এ বছর প্রায় ৩০০ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করবেন। শতকরা পাঁচ টাকা হারে হাসিল সংগ্রহ করা হবে।
সিরাজ বলেন, এ বছর অনেক বেশি টাকা দিয়ে হাটে ইজারা নিতে হচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী হাসিলের রেট বাড়াতে পারছি না। এ বছর হাটে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা থাকবে, গরু-ছাগলের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও থাকবে। এছাড়া পাইকারদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। হাটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসি ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদের টিম জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা করবে।
এদিকে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সম্প্রতি সার্বিক আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে হাট বসা নিষিদ্ধ থাকবে। পশুহাটে পশু চিকিৎসক থাকবেন। পশু কোনো নির্ধারিত হাটে নেয়ার জন্য জোর করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হাসিলের পরিমাণ সাইন বোর্ডে লেখা থাকতে হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কোরবানির পশুবাহী যানবাহন থামানো যাবে না। পশুর হাটে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প রাখা হবে। এছাড়া জাল নোট শনাক্ত করার মেশিন ও এটিএম বুথও থাকবে।
মন্ত্রী বলেন, পশুর হাট সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। এ বছর সারাদেশে কমবেশি চার হাজার ৩৯৯টি পশুর হাট বসবে বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে।