নিজস্ব প্রতিবেদক: আমাদের রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপে মগের মুল্লুকও লজ্জা পাবে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
গতকাল বৃহস্পতিবার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন বিষয়ক একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
শাহদীন মালিক বলেন, সংসদের কাজ এলাকার উন্নয়ন না। সংসদের কাজ হলো দুটি। একটা হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা, আরেকটা হচ্ছে সরকারের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আমাদের যেটা সংঘর্ষ হয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে জনবহুল ১০টি দেশের তিনটিতেই বাস্তবিক অর্থে স্থানীয় সরকার নেই। এক নম্বর হচ্ছে চীন, দুই নম্বর বাংলাদেশ এবং তিন নম্বর রাশিয়া। এসব দেশে স্থানীয় সরকার বলে কিছু নেই। যেহেতু আমাদের স্থানীয় সরকার নেই, স্থানীয় সরকারের সব উন্নয়নকাজ সংবিধান অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের করার কথা। কিন্তু আমরা স্থানীয় সরকারকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রেখেছি। আমরা দেখছি কোনো প্রার্থী মাইক পেলেই বক্তৃতা করছেনÑআমার এলাকায় কালভার্ট, স্কুল, হাসপাতাল বানাব, এই উন্নয়ন সেই উন্নয়ন করব। যে কথা স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বলার কথা, সংসদীয় নির্বাচনের প্রার্থীরা সেই ভ‚মিকায় চলে গেছেন।
তিনি বলেন, সংসদে জবাবদিহি কেন হচ্ছে নাÑকারণ সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৫৫ বা ৬০ শতাংশ। আমি যদি কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা করি, রাস্তাঘাট বানাই, এটাই আমার ব্যবসা। এখন আমি যদি সংসদ সদস্য হই, আমি কি সড়ক ও জনপদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, উপসচিবকে বা মন্ত্রীকে ডেকে সংসদীয় কমিটিতে ধমকাধমকি করতে পারব? তাহলে আমার ব্যবসার কী হবে? যেহেতু আমি ব্যবসায়ীÑতাই এখানে জবাবদিহির কোনো সুযোগ নেই।
শাহদীন মালিক আরও বলেন, আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, সংসদ সদস্যদের যে অর্থে কাজ করা দরকার, সেটা আমরা ভুলে গেছি। বর্তমানে এটা একটা দেশের সবচেয়ে বড় স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। এখন সবাই বলছে, সংবিধান মেনে চলতে হবে, সংবিধান রক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে একটি রায়ও আছে, স্থানীয় উন্নয়ন সংসদ সদস্যের কাজ নয়। আর যেহেতু তারা ব্যবসায়ী তাই তারা সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেন না। আমি ব্যবসা করি না এবং সংসদ সদস্যও নয়Ñতবে আমার ধারণা, যে আমাকে ব্যবসা দেবে তাকে যদি ডেকে এনে সংসদীয় কমিটিতে বলি আপনি এটা কেন করেছেন বা করেননি, তাহলে তো আমার ব্যবসাটা শেষ হয়ে যাবে!
মন্ত্রী-এমপিদের হলফনামায় সম্পদের পরিমাণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুদক আইনের ২৬ ধারায় বলা আছে, দুদক যেকোনো সময় তিন সপ্তাহের নোটিশ দিয়ে আমার ১০ কিংবা ১৫ বছরের সম্পত্তির হিসাব চাইতে পারে। আমি যদি ৩ সপ্তাহের মধ্যে হিসাব দাখিলে ব্যর্থ হই তাহলে ২৬ ধারা অনুযায়ী আমি অপরাধ করেছি। এর সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদণ্ড। এরপর হিসাব জমা দেয়ার পর যাচাই-বাছাই করে ইনকাম ট্যাক্সে আমি যে আয়ের হিসাব দিয়েছি, আয়ের সঙ্গে যদি সম্পত্তির হিসাব না মেলে, তাহলে সেটা ২৭ ধারার মামলা। আমরা জানি গত কয়েক বছর ধরে দুদক সবচেয়ে বেশি দোষী সাব্যস্ত করেছে ২৬ ও ২৭ ধারার মামলায়। যারা সরকারের প্রিয়ভাজন নয়, তারাই দুদকের ২৬ ও ২৭ ধারার মামলা পায়। এখন যারা অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, দুদক যদি তাদের বিরুদ্ধে ২৬ ও ২৭ ধারায় মামলা করে তাদের জবাবদিহি করত তাহলে থলের বিড়াল বেরিয়ে যেত। কিন্তু আমরা জানি দুদক এটা করবে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে একজন তরুণ প্রতিমন্ত্রীর লন্ডনে ২৫০ বা ২৬০টি ভ‚সম্পত্তি রয়েছে। আমার মনে হয়, মগের মুল্লুকও লজ্জা পাবে আমাদের রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপে।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, সমাধানের পথ হচ্ছে বর্তমানে আমাদের আনুপাতিক নির্বাচনের পথে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এলাকাভিত্তিক নির্বাচন হলেই এসব অনিয়ম হবে। অতএব আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা আমাদের গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। এছাড়া আগামী তিন-চার বছরে গণতন্ত্র তো নেই, তারপরও যেটুকু রয়েছে সেটাও আর থাকবে না।
সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে ঘোষণা, সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্য মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারÑএগুলো হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। কিন্তু এখন আমরা সেখান থেকে যোজন যোজন দূরে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা একটা পথ হারানো জাতিতে পরিণত হয়েছি।