মেহেদী হাসান, রাজশাহী : লাল বিল্ডিংয়ের রাজশাহী কলেজ জাতীয় পর্যায়ে দেশসেরার তকমা জড়িয়েছে কয়েকবার। উত্তরবঙ্গের এ প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন সুনাম কুড়িয়েছে, তেমনি কালক্রমে বেগুনপোড়া ঝুলে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী হচ্ছে। চকচকে চুনসুরকির পেছনে দগদগে রাজনীতিবিমুখতার বিশাল অট্টালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না রাজশাহী কলেজের ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে (বাম/ডান বিভাজন প্রতিফলিত হয়ে) ফাটল বেড়েছে এবং দুটি বিরোধী গণআন্দোলনের দিকে পরিচালিত করেছে। ফলে বামপন্থি কিংবা ডানপন্থি কোনো দলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নেই। একমাত্র পথ খোলা ছিল ছাত্রদের প্রতিনিধি নির্বাচন বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সেটিও তিন দশক ধরে বন্ধ। বিষয়টি যেন, ‘দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি; সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়া ঢুকি?’
কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন ইতিহাস। ৩১ বছর আগে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। এরপর স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, গণতন্ত্র এসেছে, তবে চিরতরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিদায় নিয়েছে বলেই অভিমত শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের। ফলে কলেজে রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সময় ব্যয়, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের উপর্যুপরি চিন্তা, সরকারি-বেসরকারি চাকরির চেষ্টা, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, নিরাপদ জীবনের অনিশ্চিয়তাসহ নানা কারণে রাজনীতিবিমুখতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহা. আব্দুল খালেক।
দেশসেরা কলেজে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন বন্ধ থাকলেও টুঁ শব্দটি করতে রাজি নন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা ছাত্র নেতৃত্বের কেউ। ছাত্র সংসদ না থাকায় কলেজের নানা সংকট নিয়ে কথা বলতে চান না শিক্ষার্থীরা। তারা অন্য কোনো ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দাবি আদায়ের প্রতিও সামান্যতম আগ্রহ দেখান না। এমনকি ক্ষমতাসীন কিংবা কৌশলে টিকে থাকা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেও কোনো বাক্যালাপ করতে এক পা এগোন না তারা।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি নন শিক্ষকরাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীরা পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে। রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এসেছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং সর্বোপরি ’৭১-এর স্বাধীনতা। সব আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান ছিল সবার আগে। দুঃখের বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো খুঁজে পাচ্ছে না তরুণ নেতা। ছাত্রদের খুব বড় একটা অংশই রাজনীতিবিমুখ। এটা যে আতঙ্কিত হওয়ার মতো সংবাদ, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। তরুণরা রাজনীতিতে না এলে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কী হবে, ভাবা দরকার। শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় রাজনীতি নিয়ে কথা বলা এড়িয়ে চলাই ভালো মনে করি।
রাজশাহী কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ১৫ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে কথা হয়েছে। তাদের মধ্যে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, তরুণরা রাজনীতিতে আসছে না, কারণ রাজনীতির মাঠ সমতল নয়। ইতিহাসে যা পড়ি তার সঙ্গে এখনকার সময়ের মিল নেই। এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মেধাবীদের দরকার নেই। পেশিশক্তির দরকার। চাই কেবল মাঠ দখলের রাজনীতি আর বাগাড়ম্বর। এখন মেধাশক্তির চেয়ে পেশিশক্তিই হয়ে পড়েছে প্রধান যোগ্যতা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক, শিক্ষার্থীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন এবং শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা ছাত্রনেতাদের এখন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। এসব যে অপরাধ, তা আবার ছাত্ররা করছে এবং এর ফলে আমাদের ছাত্র রাজনীতি যে পচে-গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই বোধটাও আমাদের ছাত্রনেতাদের মধ্যে নেই। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ অবস্থা এখন। ফলে রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজের সিকিউরিটি হারিয়ে দেশের কী উন্নয়ন করব? বলা যায়, সব শিক্ষার্থীই এমনটা ভাবে। তাই তারা আগ্রহ দেখায় না।
কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিব আল হাসান বলেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চলছে হানাহানির রাজনীতি। দলীয় রাজনীতি ছাত্রদের বিপথে পরিচালিত করছে। ক্ষমতা, অর্থ আর অস্ত্র পেশিশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না হতেই কে কোন দল করে, বড় ভাইয়েরা নিজেদের দল ভারী করার জন্য ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব খাটিয়ে নিজের দলে ভিড়িয়ে মিটিং-মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, নির্যাতন করে, সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে স্বার্থসিদ্ধির জন্য যা যা করার সবই করছে। এসব অন্যায়-অনাচারের কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জেনে-শুনেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তাহলে ছাত্ররা রাজনীতি করবে কেন?
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া উচিত কি নাÑএমন প্রশ্নে গণমাধ্যমকে দেয়া এক উত্তরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে, তার মানে দোষটা কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নয়। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে হয় না। ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। জাতীয় রাজনীতির একাংশ যেমন অনিয়ম-দুর্নীতি ও দখলাবাজিতে জড়িত, ঠিক তেমনি ছাত্র রাজনীতির একাংশ অনিয়ম-দুর্নীতি ও দখলাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। তার মানে এই নয় যে, এটা ছাত্র রাজনীতির দোষ। আমি ছাত্র রাজনীতির পক্ষে। ছাত্র রাজনীতিতে কিছু সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সুষ্ঠু বিকাশের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি থেকেই জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলার একটি বড় সুযোগ রয়েছে।
একই কথা বলছেন রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহা. আব্দুল খালেক। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ছাত্ররা রাজনীতি বিমুখ হয়েছে বেশকিছু কারণে। উল্লেখযোগ্য কারণ হলো পরিবর্তিত পরিবেশ, ভয়ের সংস্কৃতি, আইসিটি বা বিজ্ঞান বিষয়ে বেশি আগ্রহী হওয়া, একটা চাকরির প্রচেষ্টা, নিরাপদ জীবনসহ নানা বিষয়। ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই একটা ভালো বিষয়। ছাত্ররা যদি মনে করে তাদের রাজনীতি করার মতো পরিবেশ ও সময় হয়েছে, তাহলে তারা করতে পারে। কলেজে ৪৮টির মতো সহশিক্ষা সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠন নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা করে। নেতৃত্ব দেয়। চাকরিজীবনে গিয়ে এসব অভিজ্ঞতা কাজে দেয়।
ছাত্ররা রাজনীতে আসতে চান না কেনÑএমন প্রশ্নে রাজশাহী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তায়েজুল ইসলাম মণ্ডল শেয়ার বিজকে বলেন, যখন যে সরকার থাকে, তখন তার ছাত্র সংগঠন আধিপত্য বিস্তার করে। নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে চায়। ছাত্র সংসদ না থাকায় একক আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় নির্বাচনী একটি ধারা বন্ধ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যখন রাজনীতির উপলব্ধি গভীর হবে, তখন তারা তা গ্রহণ করবে। ছাত্রসমাজের মধ্যে ক্রমাগত ও ধারাবাহিকভাবে বৃহৎ সমর্থকদের একত্রিত করার ক্ষমতা গঠিত হলে ছাত্র সংসদ গঠিত হতে পারে।