নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সরকারগুলো পুলিশের সংস্কার চায়নি। তারা যেকোনোভাবে পুলিশকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছে। পুলিশও তাদের স্বার্থে দলীয় কাজে ব্যবহার হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পুলিশ আইনের বড় পরিবর্তন দরকার। গতকাল দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘ভয়েস ফর রিফর্ম’ আয়োজিত ‘মেরামত আলাপ’ নামে এক নাগরিক সংলাপে বক্তারা এ কথা বলেন। সংলাপের বিষয় ছিলÑ‘পুলিশের আনুগত্য হোক আইন ও জনগণের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি নয়, কীভাবে সম্ভব এই রূপান্তর?’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারের আলোচনার আগে বড় বিষয় হলো আমরা এই সংস্কার চাই কি না। আর এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা।’ পুলিশ আইনের বড় পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন সাবেক এই আইজিপি। আইনে বড় অসংগতি রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি সেগুলো পরিবর্তন করতে বলেন।
বর্তমান বাস্তবতায় পুলিশকে ‘অপারেশনাল অটোনমি’ দেয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘পুলিশে এখন অনেক মেধাবী কর্মকর্তা এসেছেন। তাদের কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে।’ নুরুল হুদা আরও বলেন, ‘ভালো পুলিশ দরকার। এজন্য নিয়োগ ঠিক করতে হবে। মৌলিক পরিবর্তন না এনে শুধু পোশাক পরিবর্তন করলে হবে না।’ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. নাজমুল হক বলেন, পুলিশ আগে থেকেই খারাপ হয়ে যোগদান করে, নাকি পুলিশে যোগ দিয়েই খারাপ হয়, সেটাই চিন্তার বিষয়। নাজমুল হক আরও বলেন, ‘দেশে দুই লাখ ২০ হাজার পুলিশ আছে। এর বেশিরভাগই এসএসসি পাস পুলিশ কনস্টেবল। এরপর ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিই। এটা খুবই অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। এরপর আর কোনো প্রশিক্ষণ তাদের দেয়া হয় না। এরপর যখন তার হাতে অস্ত্র তুলে দিই, তখন সে সেটিকে কীভাবে ব্যবহার করবে?’
সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। মামলার তদন্তে তাকে অনেক বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এখন যদি সে সঠিক প্রশিক্ষণ না পায়, তাহলে তার থেকে কি সঠিক ভূমিকা আশা করা যায়?’ সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতি এক হাজার ২০০ জনের জন্য একজন পুলিশ। মানসম্মত হলো ৪৫০ জনের জন্য একজন পুলিশ।’
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান বলেন, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালে পুলিশ সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল জনগণের কাছে জবাবদিহি। সেটি হয়নি। পরে আর সংস্কারও হয়নি।
সংস্কারের জন্য লক্ষণীয় বিষয় উল্লেখ করে মির্জা হাসান আরও বলেন, পুলিশ আইনের শাসনকে অনুসরণ করবে, দলীয় শাসনকে নয়। এজন্য পুলিশকে মানুষের কাছে যেতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘জবাবদিহি থেকে শুরু করে পুলিশের সব আইন ঢেলে সাজানো উচিত। পুলিশের যে মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদায়ন-পদোন্নতি হবে, সেখানেও জনগণের মতামতের প্রাধান্য থাকতে হবে। পুলিশে ঘুষ ছাড়া পদায়ন হয় না। ফলে সেই পুলিশ সদস্য যখন কোথাও যাবেন, ঘুষের জন্য দেয়া সেই টাকা তো তিনি মানুষের থেকেই তুলবেন। এজন্য পুরো ব্যবস্থাই সংস্কার করতে হবে।’ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলেই পুলিশ সংস্কারের আলোচনাগুলো আসে। এজন্য এই সরকার থাকতেই পুলিশ সংস্কারের কাজটি করতে পারলে হয়তো এই আলোচনা কাজে আসবে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরও প্রয়োজন আছে। নাগরিক হিসেবেও সচেতনতার প্রয়োজন আছে।’ সাংবাদিক তাসনিম খলিল বলেন, ‘পুলিশকে নিয়ন্ত্রণের ধারা থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার ধারায় নিয়ে আসতে হবে। ঔপনিবেশিক ধারা থেকে বের করে আনতে হবে।’ সংলাপে বিশেষজ্ঞরা মূল বক্তব্যের পর অংশগ্রহণকারীরা উš§ুক্ত সংলাপের মাধ্যমে তাদের মতামত তুলে ধরেন
পুলিশ নিয়ে প্রত্যাশার বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, পুলিশ সে দলের হয়ে যায়। পুরো বাহিনী দলের মতো আচরণ করে। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অপরাধের ভিত্তিতে পুলিশকে চাকরিচ্যুত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখে কেবল অপরাধকেই বিবেচনায় নিতে হবে। সংলাপের আয়োজক ‘ভয়েস ফর রিফর্মের’ পক্ষ থেকে জানানো হয়, আলোচনায় যেসব বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞরা এবং মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে যেসব বাস্তবায়নযোগ্য সমাধান ও সুপারিশ এসেছে, সেগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন গঠিত কমিশনগুলোর বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে।