Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:18 pm

রাজশাহীতে চার হাজার বিঘা জমিতে আগাম পেঁয়াজ চাষ

মেহেদী হাসান, রাজশাহী: ভারতের ‘নাসিক-৫৩’ জাতের পেঁয়াজ চাষ শুরু হয়েছে দেশে। বিভিন্ন অঞ্চলের মতো এবার রাজশাহীতে চার হাজার বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বাজারে আসবে পেঁয়াজ। চাহিদার সময়ে বাজারজাত করতে পারায় দ্বিগুণ লাভের আশা করছেন এখানকার চাষিরা।

জেলার প্রতিটি উপজেলায় চাষ হয়েছে নাসিক জাতের পেঁয়াজ। স্বাভাবিক গাছের মতো হলেও লাল রঙের গুটি বেশ বড় হয় নতুন জাতের পেঁয়াজে। কেজিপ্রতি পেঁয়াজ অন্তত ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে আশা করছেন স্থানীয় কৃষকরা।

জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের ধামইল এলাকায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করেছেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগে প্রথম প্রথম মনে করেছিলাম হবে না। কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। অনেক সুন্দর পেঁয়াজ হয়েছে। মাস খানেক পর তুলব। দাম বেশি পাব বলেই তো মনে হচ্ছে।

এসব দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অতনু সরকার। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার, ওষুধ, পলিথিনসহ প্রয়োজনীয় যা যা করণীয় সব করা হয়েছে। মাঠে গিয়ে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনিটরিং করা হয়েছে। অনেক ভালো হয়েছে পেঁয়াজ। আশা করছি এ পেঁয়াজ চাষে চাষিরা লাভবান হবে।

একই কথা জানান বাগমারা উপজেলার দক্ষিণ দৌলতপুরের হাসনীপুর এলাকার চাষি মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন। এ চাষি বলেন, আমার পেঁয়াজ বেশ ভালো আছে। গাছের চেহারা দেখার মতো। সার, পলিথিন, দড়ি, ওষুধ সবকিছু কৃষি বিভাগ থেকে দিয়েছে। শুধু জমিটা আমার, কাজকর্ম সব কৃষি বিভাগের। এখন পাতাসহ বিক্রি করতে পারব, কিন্তু এখন না পরে বিক্রি করব।

জানা যায়, রাজশাহীর চার জেলার উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে ‘তাহিরপুরি’ জাতের পেঁয়াজ চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। জেলার মোহনপুর, তানোর, চারঘাট, বাগমারাসহ সবকটি উপজেলার বেশিরভাগই চাষ হয় এ পেঁয়াজ। তবে এসব এলাকার পেঁয়াজচাষিদের কাছে নতুন এ নাসিক পেঁয়াজ বেশ সাড়া জাগিয়েছে। যেখানে স্থানীয় তাহেরপুরি পেঁয়াজ বীজ হিসেবে বাড়িতে সংরক্ষণ করতেন, সেই জায়গা দখল করতে পারে উচ্চফলনশীল নাসিক। এছাড়া গুণে ও মানে অন্যান্য পেঁয়াজের চেয়ে ভালো হবে বলেই জানা গেছে।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীর ১১ উপজেলার প্রত্যেকটিতে চাষ হয়েছে নাসিক পেঁয়াজ। প্রণোদনার আওতায় প্রথম দফায় দুই হাজার কৃষককে দুই হাজার কেজি পেঁয়াজবীজ বিতরণ করা হয়। দ্বিতীয় দফায় আরও দুই হাজার জনকে দুই হাজার কেজি হিসেবে মোট চার হাজার কৃষক চাষ করেন লাল পেঁয়াজ। প্রতি কেজি বীজ এক বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন তারা। ফলে জেলার চার হাজার বিঘা জমি ছেয়ে আছে ভারতীয় এ পেঁয়াজে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজশাহীতে ১৪ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫২৪ মেট্রিক টন পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। হেক্টরে ১৯ দশমিক ৬২ টন ফলনের আশা রয়েছে কৃষি বিভাগের।

জেলা কৃষি দপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সালমা ইসলাম বলেন, আর কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতীয় পেঁয়াজ এন-৫৩ আমরা বাজারজাত করতে পারব। দামও ভালো আশা করছি। জুলাই-আগস্ট মাসে বীজ রোপণ করে পেঁয়াজ এখন ঘরে তুলতে পারছি। অন্য ফসলের তুলনায় পেঁয়াজের দাম বেশি থাকার কারণে কৃষক লাভবান হয় এটা সত্য। সারাবছর আমদানিনির্ভরতা কমাতে আমরা মাঠে আছি। তেল ও মসলা ফসলের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, সরকার ও কৃষি মন্ত্রণালয় দেশব্যাপী পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, যা বাস্তবায়িত হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে পেঁয়াজে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। ভারতীয় নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষ দেশের জন্য অনেকটাই সুফল বয়ে আনবে এবং আমদানিনির্ভরতা কমবে। ডলার ব্যয় করতে হবে না। সেইসঙ্গে দেশের পেঁয়াজ সংকট সমাধানে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে নাসিক জাতের পেঁয়াজ চাষ-উপযোগী কি না জানতে কথা হয় বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজ অবশ্যই চাষ করা সম্ভব। যেমন তাহেরপুরী পেঁয়াজ থেকে উদ্ভাবিত বারি-১ জাতের পেঁয়াজ ভালো ফলন হচ্ছে। নাসিক জাত থেকে আসা বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ বাংলাদেশে চাষ করছেন চাষিরা। নাসিক-৫৩ জাতের এ পেঁয়াজ সংকটের সময় বাজারে আসবে, ফলে কৃষকরা অবশ্যই লাভবান হবেন। ভাদ্র মাসে চাষ করলে এখন বাজারে আসবে।

পেঁয়াজ আমদানি ও কৃষকদের নতুন জাতের পেঁয়াজ চাষের মধ্যে বৈরিতা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে পেঁয়াজের গড় ঘাটতি থাকে চার লাখ টন। এ পরিমাণ পেঁয়াজ আমরা দেশে উৎপাদন করতে পারলে আর আমদানিনির্ভর হয়ে থাকতে হবে না। তবে দেশের কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মহল ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি করে, ফলে অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয় কষ্টের ফসল। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সচেতনভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে মনে করছি।