Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 10:36 am

রাজশাহীতে চাল নিয়ে চলছে চালবাজি

আসাদ নূর, রাজশাহী: রাজশাহীতে চাল নিয়ে চালবাজি শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি মিনিকেট ও জিরাশাইল চালের দাম কমেছে তিন থেকে চার টাকা। অথচ গত দুই সপ্তাহের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৫ দিনে দুবার চালের দাম উঠানামা করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল নিয়ে মিলাররা যে চালবাজি শুরু করেছেন, তাতে কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে যেতে পারে।

খুচরা ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে চালের দাম উঠানামা করছে মিলারদের কারণে। হঠাৎ একবারে চালের দাম বাড়ালে কর্তৃপক্ষের নজরে চলে আসে। তারা বলছেন, খুচরা ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়ানোয় হাত নেই। সবকিছু হয় অদৃশ্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। সরকার মনিটর করছে ঠিকই কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙার শক্তি সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক ব্যবসায়ী।

চালের দাম বাড়া-কমার কারণ জানতে চাইলে চালকল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কথার ভিন্নতা পাওয়া গেছে। একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতেই ব্যস্ত এ দুটি মহল।

চালকল মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট কয়েক বছর ধরে সরকারের বোরো সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। বিদায়ী বছরে আগস্টের ১৫ তারিখের মধ্যে সরকারি গুদামের জন্য বোরো সংগ্রহ শেষ করার করা ছিল খাদ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলে সরকারি বোরো সংগ্রহ হয়েছিল লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশের কম। এবারও সরকারের ধান চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে জানা গেছে।

এ অঞ্চলের আটটি জেলা (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট ও পাবনা) থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়। সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলাবাজারে কৃষকদের কাছে থেকে বেশি দামে ধান কেনে অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুত ব্যবসায়ীরা। বোরো মৌসুমে লাখ মণ ধান মজুত করে বাজার নিজেদের আয়ত্তে রাখে। এখন তারা নিজেদের ইচ্ছামতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অসংখ্য অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রায় ২০০ অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুত ব্যবসায়ী বাজার রেখেছে নিজের দখলে। পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, বাজার নিয়মিত মনিটর না থাকায় এই চক্রটি যখন তখন বেপরোয়া হয়ে উঠে।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত দাম পাওয়ার আশায় চাল মজুত করে রাখছেন মিল মালিকরা। এমন অভিযোগ মানতে নারাজ মিল মালিকরা। তারা বলছেন, কভিডে অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া ধানের দাম অন্যান্য দু-পাঁচ বছরের চেয়ে বেশি। বেশি দামে ধান কেনার কারণে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মিল মালিক শেয়ার বিজকে বলেন, ভারত চাল আমদানি হলে চালের দাম কমে। এছাড়া এবার ধানের দাম বেশি। ধানের দাম বাড়লেও চালের দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকার বেশি হবে না। এটা সিন্ডিকেটের কাজ। আসলে সরষে ফুলেই ভূত লুকিয়ে আছে। দেশে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়Ñতা দিয়ে দেশে চাল আমদানির মানে হয় না। বরং আমরা রপ্তানি করতে পারি।

চাতাল ও অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরে চাল উৎপাদনকারীরা বলছেন, চালের দাম বাড়লে যাদের লাখ টন ধান-চাল মজুত করার ক্ষমতা আছে, তাদের লাভ হবে। চাতালের তেমন কোনো লাভ নেই। বরং অটো রাইস মিলের দাপটে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বলেও অভিযোগ চাতাল মালিকদের।

নওগাঁর কয়েকজন মিল চাতাল মালিক ও আড়তদার শেয়ার বিজকে জানান, এবার মৌসুমের শুরু থেকেই ধানের দাম বেশি। প্রথম থেকেই অটো রাইস মিলগুলো উল্লেখযোগ্য ধান সংগ্রহ করেছে। অটো রাইস মিল মালিকরা অনেক বেশি ধান সংগ্রহ করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ছোট ব্যবসায়ীরা বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।

ধান-চাল মজুত ও অটো রাইস মিলগুলোর দৌরাত্ম্যে ছোট মিল চাতাল মালিকরা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন, এমন অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চাকলাদার বলেন, আমরা ব্যবসা করি সরকারের বেঁধে দেয়া নীতিমালা অনুযায়ী। আমরা যদি নীতিমালার বাইরে গিয়ে মজুত করে থাকি তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।

তিনি আরও বলেন, নওগাঁয় ১২০০ চালকল রয়েছে। ৫৩টি অটো রাইস মিল। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি তাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী ব্যবসা করতে না পারেন তাহলে আমাদের করার কিছুই নেই। দু-একজনের সমস্যা হতে পারে।

নগরের মাস্টারপাড়া কাঁচাবাজারের চাল ব্যবসায়ী সুশীল কুমার বলেন, ‘চালের দাম আরও বাড়বে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। গত বছর সেপ্টেম্বরে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার মজুতদারদের হুশিয়ারি করে বলেছেন, ‘অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ কথা সর্বস্ব না হয়ে সরকার ও জনগণ একত্রে সিন্ডিকেট রুখতে ভূমিকা রাখতে হবে বলে মন্তব্য বিশ্লেষকদের।

অবশ্য সিন্ডিকেটের কথা খাদ্যমন্ত্রীর পর স্বীকার করেছেন কৃষিমন্ত্রী। গত ২৭ ডিসেম্বর কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘চলতি বছরে কয়েক দফা লাগাতার বন্যা ও পাঁচ মাসব্যাপী অতিবৃষ্টিতে আউশ ও আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। ঘাটতি মেটাতে চাল আমদানি করছে সরকার। তারপরেও এই ভরা মৌসুমেও নানান কারসাজি করে মিলাররা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।