Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 4:12 am

রাজশাহীতে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে সরষের আবাদ

প্রতিনিধি, রাজশাহী: দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, মাঠে মাঠে হলুদের সমারোহ। সরষের হলুদ ফুলের সঙ্গে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। চলতি মৌসুমে সরষে আবাদ করে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন রাজশাহী অঞ্চলের চাষিরা। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দিন দিন বাড়ছে সরষের তেলের চাহিদা। একই সঙ্গে দাম ভালো পাওয়ায় লাভের স্বপ্ন বুকে বাঁধছেন কৃষকরা।

কৃষকরা বলছেন, কম খরচে সরষে আবাদে বেশি লাভ। সঙ্গে উৎপাদনও বাড়ছে দ্বিগুণ। এছাড়া ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় বেশি পরিমাণ জমিতে সরষের চাষ হয়েছে। তিন ফসলি জমিতে এর চাষ আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে উৎপাদন করা হচ্ছে সরষের মধুও। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ অঞ্চলে চলতি মৌসুমে বেড়েছে সরষের আবাদ। সরষের ব্যাপক ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও দেখা দিতে পারে সম্ভাবনা। এছাড়া সরষে চাষ ও উৎপাদন করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এজন্য কৃষককে প্রণোদনাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে সরষের আবাদ ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বেড়েছে। গত মৌসুমে জেলার ৯টি উপজেলা ও মহানগরীতে সরষের আবাদ হয়েছিল ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। আর এবার চাষ হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে সরষে আবাদ। গত ১০ বছরে এর আবাদ বেড়েছে প্রায় চারগুণ।

জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে সরষের দানা দোল খাচ্ছে। এসব এলাকার কৃষক বলছেন, কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় তারা সরষে আবাদ করেন।

গোদাগাড়ী উপজেলার উদপুর গ্রামের কৃষক আফতাব আলী জানান, তিনি গত বছর যা আবাদ করেছিলেন, তার চেয়ে দ্বিগুণ সরষে আবাদ করেছেন। গত বছর ছয় বিঘা জমিতে সরষের আবাদ করেছিলেন। ভালো দাম পাওয়ায় এবার আবাদ করেন ১০ বিঘা জমিতে।

তানোর উপজেলার বাঁধাইড় এলাকার কৃষক বারিউল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর আগে আলুর আবাদ করতাম। আলু চাষ করে লোকসান হয়েছিল। তাই এবার সরষের চাষ করেছি। অল্প সময়ে সরষের ফলন পাওয়া যায়। খরচও কম। আবার অন্য ফসলের চেয়ে সরষে চাষে ঝামেলা কম।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সরষের আবাদ ও উৎপাদন হিসাব করে পাওয়া যায় গত ১০ বছরে সরষে আবাদ বেড়েছে প্রায় চারগুণ। ২০১২-১৩ বছরে সরষের আবাদ করা হয়েছিল ২০ হাজার ৭০৩ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ সালে ১৯ হাজার ৮১১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ সালে ১৯ হাজার ৬৯১ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল ২৪ হাজার ৮৫৫ মেট্রিক টন।

২০১৫-১৬ সালে ১৯ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার ৮৩৪ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন। ২০১৬-১৭ সালে ১৯ হাজার ৪৬১ হেক্টর জমিতে সরষে উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার ৮৫৪ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ সালে ১৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ২৩ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ সালে ২১ হাজার ২৫২ হেক্টর জমিতে সরষে উৎপাদন হয়েছিল ২৯ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ সালে ২৩ হাজার ১৯৯ হেক্টর জমিতে সরষে উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ সালে সরষে আবাদ হয়েছিল ২৩ হাজার ৫৪৩ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছিল ৩৩ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ সালে ২৬ হাজার ১৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরষে উৎপাদন হয়েছিল ৪০১ হাজার ৮২৭ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ সালে ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে সরষে উৎপাদন হয়েছিল ৬৯ হাজার ৭৫৮ মেট্রিক টন। ২০২৩-২৪ সালে সরষে চাষ হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে।

এদিকে আট বছরে সরষে থেকে মধু উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ। তবে ১০ বছরের মধ্যে দুই বছরের সরষে থেকে মধু উৎপাদনের কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। ২০১৫-১৫ অর্থবছরে ১১ হাজার ৪০০ কেজি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরষে থেকে মধু উৎপাদন করা হয়েছে ১২ হাজার ৬৩০ কেজি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মধু উৎপাদন করা হয়েছে ১০ হাজার ৫২৯ কেজি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মধু উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৩৪০ কেজি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মধু উৎপাদন হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৪৫ কেজি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ১৫ হাজার ৫৩০ কেজি। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৯৩৫ কেজি। ২০২১-২২ অর্থবছরে মধু উৎপাদন হয়েছিল ১২ হাজার ২৭৭ কেজি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মধু চাষ ও উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। এ বছর সরষে চাষে আগ্রহী হন কৃষকরা। এ বছর মধু উৎপাদন হয়েছিল এক লাখ ৬২ হাজার ৪৬০ কেজি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মধুচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার কেজি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে এবং সরষের আবাদ বাড়াতে কৃষকদের সার ও বীজ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আমি নিজেও মাঠ পরিদর্শন করেছি। কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। ফলে এ বছর সরষের ভালো ফলন হয়েছে। বেশকিছু এলাকায় সরষে কাটাও শুরু হয়েছে। জেলায় এবার সরষের বাম্পার ফলন হয়েছে। আগামী বছরেও হবে।