মেহেদী হাসান, রাজশাহী: সম্প্রতি দেশের প্রায় সব জায়গায় অতিরিক্তভাবে বাড়ছে গরুর এলএসডি বা ল্যাম্পিস্কিন ডিজিজ। এলএসডি গরুর জন্য একটা ভয়ংকর ভাইরাসবাহিত চর্মরোগ, যা খামারের ক্ষতির অন্যতম কারণ। এ রোগের গড় মৃত্যুহার আফ্রিকাতে ৪০ শতাংশ। মূলত আফ্রিকায় একাধিকবার মহামারি আকারে দেখা গেলেও বাংলাদেশের গরুতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কখনো মহামারি আকারে দেখা যায়নি। একটা খামারকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দেয়ার জন্য এফএমডি বা খুরা রোগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর রোগ হিসেবে ধরা হয় এ এলএসডি বা ল্যাম্পিস্কিন ডিজিজকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও মেট্রো অঞ্চলে সাম্প্রতিককালে বেড়েছে এ রোগের প্রাদুর্ভাব। দুর্গাপুর উপজেলায় এরই মধ্যে ২০০ গরু এলএসডিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তানোরে সারাবছরই প্রতিদিন দু-একটা গরুর চিকিৎসা করানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকতা ডা. মো. বিল্লাল হোসেন। মেট্রো অঞ্চলেও একই অবস্থা। বাগমারা উপজেলার দামনাশ, গোবিন্দপাড়া, পারদামনাশ, ভবানিগঞ্জ; পবা উপজেলার কেশরহাট ও মোহনপুরেও আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, নিয়মিত টিকা কার্যক্রম বছরজুড়েই চালু রয়েছে। ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হবে না। তবে প্রতিরোধের কিছু উপায় রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মূলত একপ্রকার পক্স ভাইরাস বা এলএসডি ভাইরাসের সংক্রমণে গবাদিপশুতে এই রোগ দেখা দেয় এবং এক গরু থেকে আরেক গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানত বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে, অথবা বসন্তের শুরুতে যখন মশা-মাছি অধিক বংশবিস্তার করে, সেই সময়ে প্রাণঘাতী এই রোগটিকে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
দুর্গাপুর উপজেলার বেশ কিছু খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিন বিশেক আগে থেকে শুরু হয়েছে এই রোগের প্রাদুর্ভাব। বর্ষার শুরুতে ও বন্যার পরবর্তী সময়ে এটি বেশি দেখা যায়। ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ায় এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ।
রোগের লক্ষণ: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার পরিচালক জিনাত আরা রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসার বিষয়ে জানিয়েছেন। আক্রান্ত হওয়ার পর আতঙ্কিত না হয়ে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন তিনি।
এলএসডি আক্রান্ত গরুর লক্ষণ শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। আক্রান্ত গরু প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং খাবার রুচি কমে যায়। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে এবং নাক দিয়ে লালা বের হয়। পা ফুলে যায়। সামনের দু’পায়ের মাঝ স্থানে পানি জমে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গা চামড়া পিণ্ড আকৃতি ধারণ করে, লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্ট হয়। ধারাবাহিকভাবে এই ক্ষত শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষত মুখের মধ্যে, পায়ে ও অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। শরীরে কোথায় ফুলে যায়, যা ফেটে টুকরা মাংসের মতো বের হয়ে ক্ষত হয়, পুঁজ কষানি বের হয়। পাকস্থলী অথবা মুখের ভেতরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে গরু পানি পানে অনীহা প্রকাশ করে এবং খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।
যেভাবে ছড়ায়: লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে রোগটি অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান মাধ্যমগুলো হচ্ছে মশা ও মাছি। এই রোগের ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসেবে মশা-মাছিকে দায়ী করা হয়। অন্যান্য কীটপতঙ্গের মাধ্যমেও ভাইরাসটি আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
লালা: আক্রান্ত গরুর লালা খাবারের মাধ্যমে অথবা খামারে কাজ করা মানুষের কাপড়ের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়াতে পারে।
দুধ: যেহেতু আক্রান্ত গাভীর দুধে এই ভাইরাস বিদ্যমান থাকে, তাই আক্রান্ত গাভীর দুধ খেয়ে বাছুর আক্রান্ত হতে পারে।
সিরিঞ্জ: আক্রান্ত গরুতে ব্যবহার করা সিরিঞ্জ থেকে এই ভাইরাস বাহিত হতে পারে।
রক্ষণাবেক্ষণকারী: খামারে কাজ করা মানুষের পোশাকের মাধ্যমে আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আক্রান্ত গরুর সিমেন: ভাইরাস আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেন এই রোগের অন্যতম বাহন, কারণ আক্রান্ত গরুর সিমেনেও এই ভাইরাস বিদ্যমান থাকে। তবে সবচেয়ে ভালো বিষয়, এই রোগে শুধু গরু-মহিষ আক্রান্ত হয়, মানুষ হয় না।
প্রতিকার ও আক্রান্ত হওয়ার পর করণীয়: যেকোনো রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিকার সব সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। আক্রান্ত গরুকে নিয়মিত এলএসডি ভ্যাকসিন দেয়া দরকার। আমাদের দেশে এর আগে রোগটির প্রাদুর্ভাব কম দেখা গেছে, তাই এই রোগের ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়। খামারের ভেতরের ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যেন মশা-মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রোগাক্রান্ত খামারে যাতায়াত বন্ধ করতে হবে এবং ওই খামার থেকে আনা কোনো সামগ্রী ব্যবহার করা যাবে না। আক্রান্ত গরুকে শেড থেকে আলাদা স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে মশা-মাছি কামড়াতে না পারে। কারণ আক্রান্ত গরুকে কামড়ানো মশা-মাছি সুস্থ গরুকে কামড়ালে এই রোগের সংক্রমণ হতে পারে। আক্রান্ত গভীর দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে ফেলে দিয়ে মাটিচাপা দিতে হবে। আক্রান্ত গরুর পরিচর্যা শেষে একই পোশাকে সুস্থ গরুর কাছে যাওয়া যাবে না। আক্রান্ত গরুর খাবার বা ব্যবহার্য কোনো জিনিস সুস্থ গরুর সংস্পর্শে আনা যাবে না। ক্ষতস্থান টিনচার আয়োডিন মিশ্রণ দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।
জেলায় ভয়ংকর এলএসডি রোগের বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, ল্যাম্পিস্কিন বা এলএসডি রোগের খবর পেয়েছি। জেলার বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্ত পশু বাড়ছে। আমরা দুর্গাপুরে টিকা পাঠিয়েছি। গরুর গায়ে মশা-মাছি যেন বসতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।