Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:44 am

রাজশাহীতে বিষাক্ত ইথোফেনে পাকানো হচ্ছে টমেটো

মেহেদী হাসান, রাজশাহী: বেশি মুনাফার লোভে রাজশাহীর কিছু অসাধু চাষি ও ব্যবসায়ী রাসায়নিক বিষ ইথোফেন দিয়ে অপরিপক্ব কাঁচা টমেটো পাকিয়ে বাজারজাত করছে। এতে একদিকে যেমন টমেটোর সঙ্গে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ খাচ্ছে মানুষ, অন্যদিকে টমেটোর পুষ্টিগুণও হারাচ্ছে। 

টমেটো পাকানোর দৃশ্য দেখলে মনে হতে পারে কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ চলছে। মোটা পলিথিন পেপারের ওপর অপরিণত কাঁচা টমেটো ছড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকজন। এরপর স্প্রে মেশিন দিয়ে টমেটোর ওপর কুয়াশার মতো ছড়িয়ে দিচ্ছে ইথোফেন। এতেই সবুজ টমেটো হয়ে উঠছে লাল টুকটুকে। সেগুলো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এভাবেই বিষাক্ত ইথোফেন দিয়ে পাকানো হচ্ছে টমেটো; ছড়িয়ে যাচ্ছে সারাদেশ।

কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইথোফেন বা ইথিফন শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে এ কেমিক্যাল মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, ইথিফন ব্যবহারের ফলে টমেটোর পুষ্টিগুণ আগের মতো থাকে না। এছাড়া অ্যাসিডিটিসহ বিভিন্ন বিপাক-সংক্রান্ত রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

গত শনিবার সরেজমিন গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ীহাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সময়ের আগে জমি থেকে কাঁচা টমেটো তুলে নেয়া হচ্ছে। এসব কাঁচা কিংবা অপরিণত টমেটো দ্রুত পাকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে কীটনাশক ইথিফন। পচন রোধ করতে টমেটোতে ছিটানো হচ্ছে ছত্রাকনাশক। বর্তমান বাজারে কাঁচা টমেটোর পাইকারি বাজার বেশ নি¤œগামী। ফলে পাকা টমেটো থেকে বেশি দাম পাওয়ার আশায় এ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তারা। অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্মকর্তাদের কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

কথা হয় আব্দুল হামিদ নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বাজারে কাঁচা টমেটো খায় না। আর পাইকারিতে কাঁচা টমেটো প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। একটু পাকলে ৮০০ টাকা থেকে মানভেদে হাজার টাকা মণও বিক্রি হয়। তাই পাকানোর ওষুধ ব্যবহার করি। তিনি জানান, শুধু আমি নই, এ এলাকায় যত চাষি আর ব্যবসায়ীরা আছেন সবাই এ পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

তিনি আরও জানান, শীত মৌসুমে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখানকার টমেটো যায়। পাকানোর জন্য এবং লাল রং করার জন্য টমেটোতে ইথিফন ও অন্যান্য ছত্রাকনাশক জাতীয় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। বাজারে টমেটো পাকানোর জন্য হরমোন কিনতে পাওয়া যায়। মেশিনের সাহায্যে এসব স্প্রে করা হয় টমেটোতে। এরপর এক দিন রোদে শুকিয়ে খড়, পলিথিন দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখা হয়। তাহলেই লাল টুকটুকে হয়ে ওঠে।

গোদাগাড়ী রাজাবাড়ী এলাকার কৃষক শান্ত রহমান বলেন, ‘জমিতে টমেটো পাকানো খুব কষ্টকর। বাণিজ্যিকভাবে টমেটো বিক্রির জন্য একসঙ্গে পাকানো জরুরি। জমি থেকে সব টমেটো কাক্সিক্ষতভাবে উত্তোলন সম্ভব নয়। জমিতে পাকা টমেটো বাজারজাত করতে গেলে অনেক টমেটো নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া শীতের কারণে টমেটো পাকতে দেরি হয়। গাছে পাকা টমেটো পাখি খেয়ে ফেলে। কাজেই কাঁচা টমেটো পাকাতে হরমোন জাতীয় কীটনাশক মেশাতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে বিষ দিয়ে টমেটো পাকানো হয় বেশি দাম পাওয়ার জন্য; অন্যদিকে বাজারজাতকরণের সুবিধার জন্য। স্বাভাবিকভাবে ১০ দিনেও পাকবে না টমেটো।’

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কেজেএম আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘রাজশাহীতে এবার ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৯০০ হেক্টর চাষ হয়েছে গোদাগাড়ীতে। জেলায় মোট উৎপাদন লক্ষ্য ধরা হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন।’

ইথিফন দিয়ে টমেটো পাকানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইথিফন কোম্পানিগুলো হরমোন হিসেবে বিক্রি করে। মূলত এটি একটি অর্গানোফসফরিক গ্রুপের কীটনাশক। অতিরিক্ত পরিমাণ ব্যবহারে বিপাকীয় সমস্যা, পেটের পীড়া কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। ’

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, ‘পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসারে নির্দিষ্ট রাসায়নিক ব্যবহার করে ফল পাকিয়ে বাজারজাত করা হয়। ইথোফেন ব্যবহার করে ফল পাকালে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে না। এটি এক ধরনের গ্যাস, যা ফলের ভেতরের এনজাইমকে প্রভাবিত করে; যার ফলে দ্রুতবেগে ফল পাকে। উন্নত বিশ্বে বর্তমানে ইথোফেন চেম্বারে ফল রাখা হয়।’