রাজশাহীতে সক্রিয় হচ্ছে ধান ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

মেহেদী হাসান, রাজশাহী : দেশের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ ঠিক রাখতে ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করছে সরকার। এতে চালের বাজারের অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারসাজিতে টান পড়েছে বেশ। অন্যদিকে ধানের সিন্ডিকেটের পোয়াবারো। চলতি মৌসুমে আউশ ধানের দাম দু-সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কমছে ২০০-২৫০ টাকা। ধান ব্যবসায়ীরা এতে ‘দাঁতে ধার’ দিলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চাষিরা।

রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে ধানের ফলনে খুশি চাষিরা। সে হিসেবে খুশির সঙ্গে মলিন মুখের সংখ্যাও কম নয়, দামে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তারা। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণ ধানের দাম কমেছে, তবে চালের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। ভোক্তা অধিকার ও সরকারের সঠিক নজরদারির অভাবে ধান-চালের বাজার ব্যবসায়ীদের দখলে থাকছে বলে অভিযোগ তাদের।

রাজশাহীর কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী ও ডিলারের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে, তারা সরাসরি একে অপরকে দুষছেন। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বড় চালকল ও অটো রাইস মিল মালিক, প্রভাবশালী মজুতদার সিন্ডিকেট ও করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে ধানের বাজার। কম দামে ধান কিনে বেশি দামে চাল বিক্রি করেন তারা। মৌসুমের বেশির ভাগ ধান মিল মালিকদের ইশারায় গায়েব হয়ে যায়। আর এ সুযোগ খোদ সরকার নিজে করে দিচ্ছে বলে দাবি চাল ব্যবসায়ীদের।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ভরা মৌসুমে চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করায় আমদানি বাড়ছে। এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারে কমছে ধানের দাম। এতে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হলেও ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ খরিপ-১ মৌসুমে ১ লাখ ৭১ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমিতে আউশ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও এর বিপরীতে অর্জন হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৩৭৮ হেক্টর। এসব জমি থেকে প্রায় ৬ লাখ ৮১ হাজার ২০১ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। চাষিরা জিরা, কাটারি, বিআর-২৬ ও ২১, ব্রি-২৮, ৫৬, ৬৫, ৮২, ৮৫, বিনা-১৯, পারিজা ও হাইব্রিড হীরা জাতের ধান চাষাবাদ করেছেন। এখন পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ জমির ধান কাটা-মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় ধান উৎপাদনকারী রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের (নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর) বিভিন্ন বাজারে মৌসুমের শুরুতে ১২০০-১২৫০ টাকা মণ দরে আউশ ধান বিক্রি হয়েছে। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণে কমেছে ২০০-২৫০ টাকা। এ অঞ্চলের হাট-বাজারে ব্যবসায়ীরা প্রতিমণ ধান কিনছেন ৮৮০-৯৩০ টাকা দরে। কোথাও ১ হাজার ১০০ টাকা মণও বিক্রি হচ্ছে। এক মণ ধান থেকে ২২-২৩ কেজি পর্যন্ত চাল হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতি কেজি চালে খরচ হচ্ছে ৪১-৪২। মিল পর্যায়ের ৪১-৪২ টাকার এই চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৫ টাকায়। অথচ এক কেজি ধান থেকে চাল তৈরি করতে খরচ পড়ে ২ টাকারও কম। চাষিরা ন্যায্যদাম থেতে চঞ্চিত হলেও ব্যবসায়ীদের পকেটে কেজিতে ১০-১২ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা যাচ্ছে।

প্রতি কেজি মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকা; আর চিকন চাল ৬৮-৭৩ টাকায় কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ধানের দাম কমলেও চালের দরে এর প্রভাব নামমাত্র। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারের চিত্রও প্রায় একই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি বিশেষজ্ঞ জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের ধান-চালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বছরজুড়ে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তারা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না কেউই। মাঝে মধ্যে নামমাত্র মজুতদারবিরোধী অভিযান হলেও তেমন একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। এছাড়া ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ধানচাষিরা। ন্যায্যদর না পেলে ধান উৎপাদন থেকে কৃষকেরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

রাজশাহীর পবা উপজেলার ধারচাষি মিনারুল ইসলাম বলেন, ধানের বর্তমান বাজার মোতাবেক হিসাব করে দেখা যায়, চালের মূল্য খুব বেশি হলে কেজি প্রতি ৪০-৪২ টাকা। কিন্তু সেখানে ৫০-৫৫ টাকা কীভাবে দাম হয় হয়? লাভ করছে ব্যবসায়ীরা, আর ধানচাষিরা কোনো ফায়দা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। একই কথা বলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের আরও ৪০-৫০ জন কৃষক।

একই এলাকার জেকের আলী বলেন, তিন বিঘা জমিতে পারিজা জাতের ধানের আবাদ করেছি। কাটা-মাড়াই করে ১৬ মণ ধান ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছি। প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ৯ হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে পেয়েছি ১২ হাজার ৮০০ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে তিন হাজার ৮০০ টাকা।

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। শুল্ক কমায় ইতোমধ্যে চাল আমদানি বেড়েছে। এছাড়া ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এসব কারণে স্বাভাবিক কারণেই চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। মোকামে চাল বিক্রি কমে যাওয়ায় মিলাররা বাজার থেকে ধান কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাজারে ধানের দাম প্রতি মণে ২০০ টাকা কমে গেছে। এছাড়া জ্বালানি তেল প্রতি লিটারে ৫ টাকা কমায় কিছুটা হলেও ধান-চাল পরিবহনে খরচ কমেছে। এসব কারণে চালের দাম কেজিতে ২-৪ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

রাজশাহী সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, মজুতদারদের আর সিন্ডিকেটের হাতে বাজার ছেড়ে দিয়ে ধান-চাল আমদানির সিদ্ধান্ত ভুল। কারণ দেশে কোনো ঘাটতি নেই সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে বলছে। তারপরও মজুতদারদের কারণে ধানের বাজার পড়ে যাচ্ছে। লোকসান গুনছেন চাষিরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, মূল্যবান সুগন্ধি (চিনি আতপ) জাতের ধান রোপণ করছেন কৃষকেরা। আউশ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চাষিরা ধানের দাম ভালোই পাচ্ছেন। বিগত বছরের তুলনায় ধানের দাম বেশ ভালো।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০