পিচঢালা পথ পেরিয়ে ইট বিছানো পথ ধরে আগানোর পর চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ঘর। চারপাশে ইটের দেয়াল, মাথার ওপরে টিনের চালা। দু-চারটি টিনের জোড়াতালিতে ছোট আয়তনের বারান্দাও আছে ঘরের সঙ্গে। দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা। অন্ধকার ঘরের এককোণে চৌকি, পাশে টেবিল। ঘরে ঢুকতেই লাইট-ফ্যান চালিয়ে দিলে চৌকি থেকে উঠে বসেন আবু ভাই। পুরো নাম আবু আহমেদ। সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের পরিচিত মুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবুর ক্যান্টিনের স্বত্বাধিকারী তিনি। সে সময় থেকে সবার কাছে তিনি আবু ভাই নামে পরিচিত।
মুখভর্তি দাড়ি আর ছলছল চোখে সেদিন তিন আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বড় মেয়ের নাতি, ছোট মেয়ে ও তার স্ত্রী পাশে এসে বসলেন। কথায় কথায় বলেন, ১৯৭৩ সালের দিকে বড় ভাই ক্যাম্পাসে কন্ট্রাকটারের কাজ করতো। ওই সময় পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ড্াচ বাংলা অফিসের কাছে (কর্মচারী অফিসের সামনে) ছোট খাবরের ক্যান্টিন দিই। সেখানে ১৯৮২ সালে পর্যন্ত ক্যান্টিন দোকান চালাই। সে বছর মারামারি হলে ১৯৮৩ সালে প্রশাসন বিজ্ঞান কারিগরি কারখানার সামনে (পানির ট্যাংকির কাছে) ক্যান্টিনের জায়গা বরাদ্দ দেয়। সেখানে ১৯৯২ পর্যন্ত চলে ক্যান্টিনটি। রাকসুর নেতাকর্মী থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যান্টিনে আসতেন। রাকুস চালু না থাকায় ক্যান্টিন এমনিই বন্ধ হয়ে গেল। এরপরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ২০১০ সালে প্রথম বিজ্ঞান ভবন ও চতুর্থ বিজ্ঞান ভবনের সামনে দোকান দিলাম। সেখানে ড্রেনের কাজ হওয়ায় আবার কিছুদিনের মধ্যে দোকান তুলে নিতে হল। এরপর আর নিয়মিতভাবে দোকান চালানো সম্ভব হয়নি। লাভ হয় না ক্রেতার অভাবে। আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থ থাকার পরও একটু সুস্থ হলে ক্যাম্পাসে যাই। সারাদিন থেকে বাড়িতে আসি।
ক্যান্টিন দেখার আশা নিয়ে আবু ভাই বলেন, সুস্থ হয়ে ক্যাম্পাসে সুন্দর একটি ক্যান্টিন দেখে যেতে পারলে আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। আর এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। প্রশাসন চতুর্থ বিজ্ঞান ভবনের পশ্চিম দক্ষিণ একটি জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে বলে শুনেছি। জায়গা ঠিক হলে আশা করি ছাত্ররা আমার ক্যান্টিন তৈরি করে দিবে। আমি সে ক্যান্টিনে ছেলেদের নিয়ে খাবার তৈরি করে ছাত্রদের খাওয়াবো আর
গল্প করব।
ছোট মেয়ে ময়না বেগমের শ্বশুরবাড়ির কাছে হওয়ায় বাবার যত” নিতে চলে এসেছেন। ওষুধ খাওয়ানো, গোসল করানো ও খাওয়ানোর কাজ করছেন। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে বৃষ্টির পর আব্বু বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে পায়ে আঘাত পান। পায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ডায়াবেটিস, কিডনি ও অ্যাজমার সমস্যা ধরা পড়ে। সবশেষ গত ৮ এপ্রিল হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এক সপ্তাহ জ্ঞানহীন ছিলেন। ১৯ এপ্রিল আব্বুকে বাড়িতে নিয়ে আসি। এখন বিছানায় শুয়ে থাকেন। অসুস্থতার কথা শুনে লিটন ভাইসহ
সাংবাদিক-শিক্ষকরা দেখতে এসেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্বই দশকের সাবেক শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবু ভাই শুধু একটি আবেগের নামই নয়, তিনি সহযোদ্ধাও ছিলেন। আমাদের সময় ক্যাম্পাস অন্যরকম ছিল। রাকসু সচল ছিল আবার স্বৈরাচার শাসনের প্রভাব ছিল। হুট করে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যেত। এতকিছুর মাঝেও মিছিল সমাবেশ নাটক গানে ক্যাম্পাস সরব ছিল। স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতাম। এগুলো শেষে আমাদের জায়গা ছিল আবু ভাইয়ের ক্যান্টিন। সেখানে চা থেকে কম টাকায় সিঙ্গারা খেয়ে সময় পার হতো। খুব যতœ করে আমাদের খাওয়াতেন। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও ছিল ভাইয়ের ক্যান্টিন। এমনকি তিনি নিজেও আমাদের রাজনৈতিক আড্ডার অংশ হয়ে যেত। কখনও আবু ভাই নিজেই বলতেনÑযাও কয়েক কাপ চা তো টাকা লাগবে না। তিনি আমাদের পাশে ছিলেন। আমাদের উচিত হবে এখন আবু ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক বলেন, ১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সে সময় আবু ভাইয়ের ক্যান্টিন ছিল সায়েন্স ওয়ার্কশপের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অর্থাৎ বর্তমান টিএসসিসি ভবন ও পানির ট্যাংকির পূর্ব দিকে। আবু ভাইয়ের ক্যান্টিনে তখন জৌলুস না থাকলেও প্রাণ ছিল। ভাঙা ইটের গাঁথুনির ওপর পোড়া টিনের চাল থাকলেও ক্যান্টিনের ভেতর চকচকে ছিল। পরিষ্কার থালা বাসন, গ্লাস আর সস্তায় দুপুরের খাবারের সঙ্গে মিলতো শাকসবজি, মাছ, মাংস, আলু ভর্তা ও ভাজি। সিঙ্গারা-পুড়ি নাস্তার জন্য রাকসু ভবন থেকে সাংস্কৃতিক কর্মী, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কর্মী, সাংবাদিক আর ক্লাস ফেরত শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা ছিল এ ক্যান্টিন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে ঢেউ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগত তার সূতিকাগার আবুর ক্যান্টিন। আবু ভাইয়ের পছন্দের জায়গায় একটি ক্যান্টিনের অনুমোদন চেয়ে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ দারার সুপারিশযুক্ত আবেদন দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের সে আবেদনে নিশ্চয় সাড়া দেবে। রাকসুর সাবেক মহিলা সম্পাদিকা বৃত্বা রায় দীপা বলেন, ক্যান্টিনের জন্য প্রশাসনের জায়গা বরাদ্দ দেওয়াটা মানবিক ও যৌক্তিক হবে। আর ক্যান্টিন নির্মাণের জন্য আমাদের সময়ের যারা সংসদের দায়িত্বে ছিলাম তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। রাকসুর সাবেক ভিপি ও রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আবু ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তিনি এখন অসুস্থ, আমাদের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো। আবু ভাইকে সার্বিকভাবে সহযোগিতার জন্য ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নেব। বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মো. জাহিদ আলী বলেন, জায়গা বরাদ্দের বিষয়টি ঠিক আছে। তিনি দুটো জায়গা চেয়ে আবেদন করেছিলেন, সাব-কমিটি তা পরিদর্শন করেছে। তিনি সুস্থ হয়ে আসলেই ক্যান্টিনের জন্য আমরা সবাই সহযোগিতা করব। আশা করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, আবু ভাইয়ের অসুস্থতার খবর জানতে পেরেছি। তাকে দেখতে যাবো। ব্যস্ততার কারণে যেতে পারিনি। আর মানবিক কারণেই আবু ভাইকে সহযোগিতার জন্য সবার এগিয়ে আসা উচিত। ক্যান্টিনের জায়গা প্রসঙ্গে বলেন, দাবি থাকতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি দেখবে। এটা তো আমার একার বিষয় না। এ স্টেট অফিস আছে, ভিসি স্যার আছেন, সবাই দেখবেন বিষয়টি।
আলী ইউনুস হৃদয়