রাজস্ব ফাঁকির অলরাউন্ডার ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস

সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: রাজস্ব ফাঁকির অলরাউন্ডার প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিইপিজেডের মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড। প্রতিটি বিভাগে রাজস্ব ফাঁকিতে পারদর্শী এ প্রতিষ্ঠানটি। তিন দেশের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটে ‘এ’ ক্যাটেগরিতে নিবন্ধিত। তবে যাত্রা শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকির সম্ভাব্য একটি পথও ছাড়েনি। গত ১১ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ফাঁকি দিয়েছে ৬৮৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রত্যাবাসিত না হওয়া, অবৈধ আমদানি, ইএক্সপি জালিয়াতি, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে মেশিনারিজ, কাঁচামাল ও গাড়ি অবৈধ অপসারণ সবই করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম নিয়ে দুটো প্রতিবেদন করেছে শেয়ার বিজ, যাতে রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ছিল ৬৬২ কোটি তিন লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এবার বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ২১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির তথ্য পেয়েছে শেয়ার বিজ।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির তাদের সিইপিজেডের মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড থেকে কর্ণফুলী ইপিজেডে বরাদ্দকৃত প্লটে নির্মাণকাজ শেষ হওয়া না পর্যন্ত কর্ণফুলী ইপিজেডে অবস্থিত তাদের অন্য প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই অ্যাপারেলস লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানে পণ্য সংরক্ষণের জন্য আবেদন করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট নিরীক্ষা-সংক্রান্ত সব দলিলপত্র দাখিল করে দুই মাসের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবেÑএমন শর্তে অনুমোদন দেয় প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী সময়ে কোনো চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়নি, এমনকি কর্ণফুলী ইপিজেডে মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড নামে কোনো প্রেতিষ্ঠানও স্থাপন করেনি। ফলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য গ্রহণ করে তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট।

পরবর্তী সময়ে ওই কমিটি চট্টগ্রাম কন্ড কমিশনারেটকে জানায়, প্রতিষ্ঠনটি বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত ৭৯৮ সেট মেশিনারিজ অবৈধ আমদানি করে আট কোটি ৬৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। অন্যদিকে বন্ড সুবিদায় আমদানিকৃত কাঁচামাল অপসারণ করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত গাড়ি অপসারণ করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ২৬ লাখ ৫ হাজার টাকা। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধা গ্রহণ করে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রত্যাবাসিত হয়নি। এতেও সাত কোটি ৩৯ লাখ ৯ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে। তার আগে পণ্য অবৈধ অপসারণের মাধ্যমে ১০৬ কোটি ৭৫ লাখ ও ইএক্সপি জালিয়াতি করে ৫৫৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির প্রতিবেদন করেছে শেয়ার বিজ।

চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারের তদন্ত কমিটি তাদের উত্থাপিত প্রতিবেদনে জানায়, মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ৭৯৮ সেট মেশিনারিজ অবৈধ অপসারণ করেছে, যার শুল্কায়ন মূল্য ২৬ কোটি ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধ অপসারণের কারণে সরকারের রাজস্ব হারিয়েছে আট কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অপর একটি প্রতিবেদনে ওই কমিটি জানায়, প্রতিষ্ঠানটি প্রত্যেক বছরের যে পরিমাণ পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি করেছে, তার তুলনায় যে পরিমাণ রপ্তানি করেছে ওই রপ্তানি পণ্যে ব্যবহƒত কাঁচামালের পরিমাণ বাদ দিয়ে এক লাখ ৪৬ হাজার ৮৩৯ কেজি কাঁচামাল পাওয়া যায়। তবে প্রতিষ্ঠানটির কাছে সমাপনী মজুদের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। অর্থাৎ এই পণ্যগুলো অবৈধ অপসারণের বিপরীতে রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি শুল্কমুক্তভাবে দুটি গাড়ি আমদানি করে, যার শুল্কায়ন মূল্য ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে সরকারি রাজস্ব আসে ২৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। তবে বন্ড সুবিধায়

 আমদানিকৃত গাড়ি দুটি কমিটির সম্মুখে উপস্থিত করতে বলা হলে তাতেও ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটির দাখিলকৃত ইএক্সপিসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন পিআরসি ভেরিফাই পেজে যাচাই করা হলে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের ৩৩টি ইএক্সপি রপ্তানি মূল্য আজ অবধি প্রত্যাবাসিত হয়নি। এই ৩৩টি ইএক্সপি প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে দাখিল করেছিল। অর্থাৎ এই অপ্রত্যাশিত রপ্তানির বিপরীতেও রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে সাত কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়। বন্ড কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির কাছে অসঙ্গতি সম্পর্কে ব্যাখা চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালার পালনীয় শর্তাবলি সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে, যা শাস্তিমূলক অপরাধ ও লাইসেন্স বালিতযোগ্য। তাই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিস জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিগত শুনানি চাইলে লিখিত জবাবে উল্লেখ করার জন্য বলা হয়েছে। অন্যথায় সরকারি রাজস্ব সংরক্ষণ ও ন্যায়-বিচারের স্বার্থে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রাজস্ব ফাঁকির মামলাটি এক তরফা নিষ্পত্তি করা হবে।’

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম সিইপিজেডের এফএস-২নং প্লটে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ‘বি’ ক্যাটেগরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরে কোম্পানিটি মালিকানা শেয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে ‘বি’ ক্যাটেগরি থেকে ‘এ’ ক্যাটেগরিতে পরিবর্তিত হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া শুরু করে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি কোনো বার্ষিক নিরীক্ষাও সম্পন্ন করেনি। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট থেকে একাধিকবার চিঠি দিয়েও করানো যায়নি কোনো অডিট। একই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি তথ্য প্রেরণের জন্য প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট লিয়েন ব্যাংক থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। ওই ব্যাংক বরাবর একাধিকবার চিঠি দিলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি বন্ড কমিশনারেটকে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০