রহমত রহমান: দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব বকেয়া প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে এই টাকা আদায় হচ্ছে না। বকেয়া আদায়ে সভা ও সিদ্ধান্ত হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। দুটি প্রতিষ্ঠান হলোÑরাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, দুই প্রতিষ্ঠানের বকেয়া আদায় হলে এনবিআরকে দেয়া লক্ষ্যমাত্রার ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হতো।
আবার সিএজির নিরীক্ষা অনুযায়ী, কেবল পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা আদায় হলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। পেট্রোবাংলা ও বিপিসির এই বকেয়া কর আদায়ে সম্প্রতি এনবিআরে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বকেয়া আদায়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, পেট্রোবাংলা ও বিপিসি’র বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া রাজস্ব নিয়ে চলতি বছরের ২০ মে এনবিআরের সম্মেলন কক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। সভায় অর্থ সচিব, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব, বিপিসির চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, এনবিআরের আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস অনুবিভাগের সদস্য, কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেটের প্রতিনিধি ও বিপিসির বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, পেট্রোবাংলা, বিপিসি ও এর বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ ৫৪ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কাস্টমসের ১৭ হাজার তিন কোটি, আয়কর ১৩ হাজার ৫৫০ কোটি ও মূসক ২৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
সভায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের প্রতিনিধি জানান, পেট্রোবাংলার কাছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বকেয়া ১৪ হাজার ৭১৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এলএনজি আমদানিতে এই বকেয়া পড়েছে। বকেয়া সংশ্লিষ্ট কোনো মামলা চলমান নেই। ফলে এই বকেয়া নিরঙ্কুশ হিসেবে বিবেচিত। এই বিষয়ে সভায় উপস্থিত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জানান, বিদ্যুৎ ও সার খাতে যে পরিমাণ পাওনা রয়েছে, তা পরিশোধিত হলে এনবিআরের যাবতীয় বকেয়া পরিশোধ সম্ভব। তবে অর্থ বিভাগ বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করলে এই বকেয়া পরিশোধ সম্ভব হবে। পেট্রোবাংলা এই বকেয়া দ্রুত পরিশোধে ব্যবস্থা নেবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
অপরদিকে বিপিসির বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও রংপুর ভ্যাট কমিশনারেটের বকেয়ার পরিমাণ দুই হাজার ২৯৯০ কোটি টাকা। সভায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের প্রতিনিধি বলেন, বিপিসির প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বকেয়া দুই হাজার ৬৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছেÑমেঘনা পেট্রোলিয়ামের ৮০৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা, পদ্মা অয়েলের ৬৩৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা, যমুনা অয়েলের ৪৪৭ কোটি ৮৭ লাখ ও ইস্টার্ন রিফাইনারির ১৭১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। সভায় রংপুর ভ্যাট কমিশনারেটের প্রতিনিধি বলেন, বিপিসির প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে এই কমিশনারেটের বকেয়া ২২২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছেÑপদ্মা অয়েলের ৮০ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ৯৪ কোটি ১৫ লাখ ও ৪৮ কোটি ৩২৭ লাখ টাকা নিরঙ্কুশ বকেয়া রয়েছে।
সভায় ‘আমদানি শুল্ক খাতে বকেয়া আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান’ করার অনুরোধ জানানো হয়। সভায় এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) বলেন, প্রতি বছর জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত বাজস্ব এনবিআরকে আহরণ করতে হয়। পেট্রোবাংলা ও বিপিসির কাছে যে পরিমাণ বকেয়া আছে, তা পরিশোধ করা না হলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। ফলে আমদানি শুল্ক হিসেবে বকেয়া পরিশোধের লক্ষ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদানের জন্য অর্থ সচিবকে অনুরোধ জানান তিনি। অর্থ বিভাগের সচিব সভাকে অবহিত করেন যে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে যে বাজেট বরাদ্দ প্রদান করা হয়, তার একটি অংশ যাতে বকেয়া শুল্ক আদায়ে ব্যবহƒত হয়, সেজন্য অর্থ বিভাগ শর্ত আরোপ করে বরাদ্দ প্রদান করতে পারে। অন্যদিকে এনবিআর সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) সভায় জানান, পেট্রোবাংলার কাছে কর অঞ্চল-৮, ঢাকার বকেয়া ২৫০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৬৪ কোটি টাকা অবিতর্কিত। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, এই বকেয়ার টাকা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই পরিশোধ করা সম্ভব এবং খুব দ্রুত তা পরিশোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে সভায় এনবিআর সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) জানান, পেট্রোবাংলার কাছে এলটিইউ (ভ্যাট) এর মূসক বকেয়া ২২ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার বকেয়া আদায়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ সচিবালয়ে সভা করেছেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যেÑকম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের নিরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর আগের বকেয়া মূসক ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা (সুদ ব্যতীত) পর্যায়ক্রমে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধের বিষয়ে অর্থ বিভাগ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সভায় অর্থ সচিব মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঐকমত্য পোষণ করেন। অবশিষ্ট বকেয়ার আংশিক অংশ পেট্রোবাংলা ২০২৩-২৪ অর্থবছর পরিশোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর অবশিষ্ট বকেয়া রাজস্ব বুক অ্যাডজাস্টমেন্টে অর্থ বিভাগ ব্যবস্থা নেবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
অন্যদিকে সভায় জানানো হয়, বিপিসির বিভিন্ন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের বকেয়া ১৬৩৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছেÑপদ্মা অয়েল কোম্পানির এক হাজার ৪১১ কোটি ৯২ লাখ টাকা, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ৩৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ও ৩৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যমুনা অয়েলের ৪১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের ১০৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বকেয়া সংশ্লিষ্ট কোনো মামলা চলমান না থাকায় দ্রুত বৈঠক করে পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের (সিএজি) নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ সুদসহ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর সূত্র বলছে, পেট্রোবাংলা থেকে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে বকেয়া কর আদায়ে ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, এলটিইউ (ভ্যাট)-এর বকেয়া রাজস্বের ১৬ হাজার ৭৭৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া পরে আরও কয়েকটি সভায় এই টাকা পর্যায়ক্রমে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পেট্রোবাংলা পরিশোধ করবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বকেয়া রাজস্ব বিষয়ে কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল অফিস একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে। কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল অফিস পেট্রোবাংলার ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০১৬-২০১৭ (২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) অর্থবছর পর্যন্ত অডিট সম্পন্ন করে। এতে দেখা গেছে, পেট্রোবাংলার কাছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ২৫ হাজার ৯২৮ কোটি তিন লাখ টাকা এবং সুদ বাবদ ৪৪ হাজার ৮৬৮ কোটি তিন লাখসহ মোট বকেয়া ৭০ হাজার ৭৯৬ কোটি ছয় লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ২০ বছরে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ ৭০ হাজার ৭৯৬ কোটি ছয় লাখ টাকা। তবে মূল বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করায় সুদের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। তবে পেট্রোবাংলা বিভিন্ন সময় সরকারি কিছু বকেয়া পরিশোধ করেছে। ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে এলটিইউ’র বকেয়ার পরিমাণ সুদ ছাড়া ২২ হাজার ৫৮৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।